স্মরণে আবেশ। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
মুদিয়ালির বাড়িতে মঙ্গলবার ছিল আবেশের পারলৌকিক কাজ। আর এ দিনই সকাল থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলিতে ‘ভাইরাল’ হয়ে গিয়েছে একটি দাবি: ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
১৭ বছরের আবেশ দাশগুপ্তের রহস্য-মৃত্যুর সুবিচার চেয়ে এ ভাবেই সরব হয়েছেন আত্মীয়, বন্ধু এবং চেনা-অচেনা বহু মানুষ।
কালো কালির মোচড়ে ফুটে ওঠা, মোটা ফ্রেমের চশমার হাসিখুশি কিশোরের বুকের কাছে লেখা, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’! আবেশের ছবিটা তার থেকেও বয়সে ছোট এক বন্ধুর আঁকা। আবেশের রহস্য-মৃত্যুর জট দ্রুত খোলার দাবিতে ফেসবুকের ওই পেজ ‘জাস্টিস ফর আবেশ দাশগুপ্ত’। সোমবার রাতে আবেশের মামা হৃদেশ ঠক্কর ‘পেজ’টি তৈরি করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা কয়েক হাজার অনুগামীরও স্বর হয়ে ওঠে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠিও ফেসবুকের পাতা থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে।
আবেশের মৃত্যু খুন না দুর্ঘটনা— তা এখনও স্পষ্ট করে বলতে নারাজ পুলিশ। কিন্তু আবেশ ও তার পরিবারের সুহৃদদের তরফে এই চিঠি স্পষ্টই খুনের কথা বলছে। ঠিকঠাক তদন্ত করে দোষীদের সাজার দাবি তুলেছে এই চিঠি। যাতে বলা হয়েছে, শনিবারের ওই সন্ধ্যায় সানি পার্কের আবাসন চত্বরে সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে আবেশের মৃত্যু ঘটে। দাবি করা হয়েছে, ঘটনার কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধুর সঙ্গে আবেশের ঝামেলা বাধে, যা তাকে নিষ্ঠুর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সামাজিক ইস্যুতে আর্জি জানানোর ওয়েবসাইট, ‘change.org’-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেই চিঠি।
এই অঘটনের পরে পুলিশ বা মিডিয়ার সংবেদনশীল ভূমিকার অবশ্য প্রশংসা করেছে আবেশের পরিবার। পুলিশের উপরেও তারা আস্থাশীল। কিন্তু পুলিশের একাংশ এই মৃত্যু ‘দুর্ঘটনা’ বলে দেগে দিতে চাইছে বলে ফেসবুকে ওই কিশোরের পরিবারের তরফে আক্ষেপ করা হয়েছে। পরিবারের বক্তব্য, ‘আবেশের জীবন আমাদের কাছে খুব দামি ছিল। তার বন্ধুদের জীবনও দামি। তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আবেশকে খুনের পরে প্রমাণ লোপাট করে দোষীরা পার পেয়ে গেলে, তা গোটা সমাজের জন্যই এক নেতিবাচক নমুনা হয়ে থাকবে।’
ফেসবুকের পেজে আবেশকে মনে রেখে বা ঠিকঠাক পুলিশি তদন্তের দাবিতে আরও অনেকের ‘পোস্ট’ ‘শেয়ার’ করা হয়েছে। আবেশের জন্য এই পেজটি ছড়িয়ে গিয়েছে আরও অনেক পরিচিত-অপরিচিতর ফেসবুক ‘ওয়াল’-এ। তৈরি হয়েছে ট্যুইটার হ্যান্ডেলও। এ দিন শহরের রাস্তায়-রাস্তায় এ নিয়ে লিফলেট বিলি করেছেন পরিজনেরা। ইতিমধ্যে বেশ কিছু রাজনৈতিক সংগঠনও ব্যানার-ফেস্টুন হাতে পথে নেমেছে।
আবেশের পরিবারের জন্য সহমর্মিতার এই সুর বুধবার দিনভর তাঁদের বাড়িতেও টের পাওয়া যায়। পরিবারটি দীর্ঘদিন টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। আবেশের দাদু পোড়খাওয়া ফাইট মাস্টার শান্তনু পাল। ইতিমধ্যে আবেশদের পারিবারিক বন্ধু চলচ্চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায় এই ঘটনায় খুবই বিচলিত হয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ দিন আবেশের মা রিমঝিম দাশগুপ্তের সঙ্গে দেখা করেন পারিবারিক বন্ধু অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও। পরে তিনি বলেন, ‘‘ওর পরিবারের পাশে রয়েছি। আমি চাই আবেশের মৃত্যুর ন্যায়বিচার হোক। আমি নিজে প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি।’’ পার্ক স্ট্রিটের একটি কনভেন্ট স্কুলের পড়ুয়া আবেশের সহপাঠী ছ’-সাত জন বন্ধুও এ দিন রিমঝিমের সঙ্গে দেখা করে। সুবিচারের দাবি তুলেছে তারাও।
আবেশের জন্য ন্যায়-বিচারের লড়াইটা চেনা-অচেনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই বদ্ধপরিকর আবেশের পরিবার। ঠিক হয়েছে, লেক অ্যাভিনিউয়ে তাদের বাড়িতে ফি-সন্ধেয় প্রতীকী মোমবাতি জ্বালিয়ে আবেশের খুনের কিনারার দাবি তোলা হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সবাইকে সেই মোমবাতি-প্রতিবাদে যোগ দিতে বলা হয়েছে। এর আগে দিল্লিতে জেসিকা লাল হত্যাকাণ্ড বা কলকাতায় রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর পরে দেখা গিয়েছিল মোমের আলোর এই শান্ত প্রতিবাদ। ফেসবুকে ‘আবেশের সুবিচারের জন্য’ পাতাটিতে বলা হয়েছে— ‘আসুন, আবেশের জন্য একটি করে মোমবাতি জ্বালান।’ এ দিন বিকেলেও জ্বলেছে সেই মোমবাতি। পাশে একটি বড় ফ্লেক্সে আবেশের উদ্দেশে দু-এক লাইন করে লিখেছেন আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনেরা। এগিয়ে এসেছেন পথচারীরাও।
ঘটনায় আবেশের যে বান্ধবীর নাম জড়িয়েছে, শনিবারের পার্টিতে সে উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও তদন্তে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। রবিবারই ওই কিশোরী জানিয়েছিল, এক মাসের পরিচয়ে আবেশের সঙ্গে তার খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তারা পরস্পরকে পছন্দও করত। তবে শনিবারের পার্টির কথা তার জানা ছিল না। এ দিন ওই কিশোরী বলে, ‘‘আবেশের ভাল বন্ধু হিসেবে ওর মায়ের পাশে আছি। তদন্তেও সব রকম সাহায্য করব।’’ আবেশের মা বলেন, ‘‘বন্ধুদের তো এমনই হওয়া উচিত।’’
সন্ধ্যায় রিমঝিমদেবীর পাশে দাঁড়িয়েছেন টলিউডের অনেকেই। ছিলেন দেবজ্যোতি মিশ্র, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় (পরশপাথর), শুভেন চট্টোপাধ্যায় (পারকাশনিস্ট) প্রমুখ। মোমবাতি জ্বালান তাঁরা। ‘একঝাঁক ইচ্ছেডানা’র সুরের সঙ্গে মিশে যায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-এর দাবি। দেবজ্যোতি বলেন, ‘‘নাগরিক সমাজের প্রত্যেক প্রতিনিধিকে সামনে আসতে অনুরোধ করছি। তদন্তে গাফিলতি আমরা মেনে নেব না, যত দূর সম্ভব যাব সুবিচারের দাবিতে।’’ শুভেনবাবুও ছোটবেলা থেকেই চিনতেন আবেশকে। রবিবার পরিবারের সঙ্গে শ্মশানেও যান তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘আমি দেহের ক্ষত দেখেছি। এটা খুন ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না।’’
এ দিন রাত ন’টা নাগাদ আবেশের বাড়ি যান ডিসি ডিডি (২) নীলু শেরপা চক্রবর্তী। রিমঝিমদেবীর সঙ্গেও কথা বলেন তিনি।