আব্বাস সিদ্দিকি (মাঝখানে) আসতেই হইহল্লা তাঁর সমর্থকদের। মাঝপথেই বক্তৃতা থামান অধীর চৌধুরী। অপেক্ষা করতে বলেন মহম্মদ সেলিম। বিমান বসুর অনুরোধে ফের শুরু বক্তৃতা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ভরা ব্রিগেডে ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) প্রধান পৃষ্ঠপোষক আব্বাস সিদ্দিকিকে ঘিরে উন্মাদনা যে ভাবে আড়াল করে দিল প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে, তা নিয়ে জলঘোলা হতে শুরু করেছে। যে মঞ্চ থেকে ‘সংযুক্ত মোর্চা’র ঘোষণা হল, সেই মঞ্চেই এমন ঘটনায় তাল কেটেছে জোট-শিবিরে।
নাটকীয়তার সূত্রপাত রবিবাসরীয় ব্রিগেডে আব্বাসের প্রবেশের সময় থেকেই। ব্রিগেডের ময়দানে বিরাট সংখ্যায় হাজির আইএসএফ সমর্থকেরা গোড়া থেকেই সরব ছিলেন। মঞ্চে আব্বাসকে দেখা মাত্রই তাঁরা প্রবল স্লোগান দিতে শুরু করেন। সেই সময়ে বক্তৃতা করছিলেন অধীরবাবু। হইচইয়ের মধ্যে তিনি প্রথমে বক্তৃতা থামিয়ে দেন। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম এগিয়ে গিয়ে তাঁকে কিছু বলতেই বক্তৃতা বন্ধ করে সরে যেতে চান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। তখন হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায় বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। অধীরবাবুকে প্রবীণ বাম নেতা অনুরোধ করেন, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বলতে শুরু করেছেন, বক্তৃতা যেন শেষ করেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা সম্পূর্ণ করেন অধীরবাবু। নিজের সমর্থকদের শান্ত হতে অনুরোধ করেন আব্বাসও। তবে নমস্কার করে আব্বাস সৌজন্য বিনিময়ে উদ্যোগী হলেও মুখ ঘুরিয়ে নিতে দেখা যায় অধীরবাবুকে।
তিক্ততার রেশ বজায় ছিল এর পরেও। নিজের বক্তৃতায় কংগ্রেসকে আরও বিড়ম্বনায় ফেলেন আব্বাস। বাম প্রার্থীদের জন্য রক্ত দিয়ে লড়াইয়ের কথা বললেও কংগ্রেসের নাম করেননি তিনি। পরে নিজেই সেই প্রসঙ্গ আবার এনে আব্বাস বলেন, ‘‘কেউ বলতে পারেন, কেন আমি কংগ্রেসের কথা বলছি না? বামেরা সদিচ্ছা দেখিয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে। কংগ্রেসকে বলছি, বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে আমাদের দরজা খোলাই আছে। তাদের জন্যও লড়াই করব।’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘আমরা ভাগ চাইতে এসেছি, তোষণ করতে নয়! বাবাসাহেব বলেছিলেন, ভিক্ষে করে কিছু মেলে না। হক বুঝে নিতে হয়।’’
মঞ্চে বসে গোটা ঘটনারই সাক্ষী থেকেছেন এআইসিসি-র পর্যবেক্ষক জিতিন প্রসাদ। সভার অবসরে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ও সেলিমের সঙ্গে কথাও হয়েছে তাঁর। দিল্লি ফিরে গিয়ে তিনি কী বার্তা দেন, সে দিকে নজর রয়েছে কংগ্রেস শিবিরের। এরই মধ্যে আজ, সোমবার ফের আসন নিয়ে আলোচনায় বসার কথা সিপিএম ও কংগ্রেসের।
মঞ্চের ঘটনাকে পরে অবশ্য লঘু করেই দেখাতে চেয়েছেন অধীরবাবু। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির ব্যাখ্যা, হইচই হচ্ছিল বলে তিনি থেমেছিলেন। সেলিম একটু অপেক্ষা করতে বলছিলেন। বিমানবাবু অধীরবাবুকে বলতে বলায় তিনি আবার বক্তৃতা শুরু করেন।
তবে আসন-রফার প্রশ্নে জটিলতা কাটেনি। সভার পরে প্রশ্নের জবাবে আব্বাস আরও বলেছেন, ‘‘আমরা বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। যত দূর জানি, দিল্লিতে সনিয়া গাঁধী জোট চাইছেন। কিন্তু এখানে কেউ ঢিলে করছে! আমরা বেশি দেরি করতে পারব না। আমাদের দরজা খোলা আছে, সদিচ্ছা থাকলে আসতে পারেন।’’
আইএসএফের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অধীরবাবুর বক্তব্য, ‘‘আব্বাসের কথায় তো আমাদের দল চলে না! আমাদের জোট হচ্ছে বামেদের সঙ্গে। অন্য কে কী বলল, তাতে কিছু যায় আসে না! বামেদের সঙ্গে রফা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। নিজেদের ভাগের কড়িই জানি না, অন্যদের কী আসন দেব!’’ সিপিএম নেতৃত্বের একাংশও মনে করছেন, ব্রিগেডের মঞ্চে আব্বাস ওই কথা বলে ঠিক করেননি। রাজনীতিতে তিনি নবাগত বলেই হয়তো এমন সমস্যা। আব্বাস অবশ্য নিজেও মঞ্চে বলেছেন, ‘‘কোনও কথা কারও কটু মনে হলে ক্ষমা করে দেবেন।’’ আর সেলিম বলেন, ‘‘সমস্যা হবে না। লড়াইটা একসঙ্গেই হবে।’’
কংগ্রেস নেতাদের একাংশের অবশ্য মত, আব্বাসেরা এ বারের ভোটে ‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারেন বলে প্রথম উল্লেখ করে সনিয়ার কাছে জোটের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। তার পরে মান্নান ও প্রদীপ ভট্টাচার্য আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দিলে এই দিন দেখতে হত না! শেষ পর্যন্ত আব্বাসের সঙ্গে তাদের সমঝোতা না হলে মুর্শিদাবাদ, মালদহ বা দক্ষিণবঙ্গের নানা জায়গায় কংগ্রেসেরও বিপদ বাড়তে পারে।
ভোটের মুখে ব্রিগেডে এ দিন দেখা গিয়েছে কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি, আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরীদেরও। কংগ্রেস সূত্রের খবর, ডালুবাবু এর আগে আব্বাসদের কাছে গিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাঁর বিধায়ক-পুত্র ইশার আসনে প্রার্থী না দিতে। ফলে, আব্বাসদের আচরণে ‘রুষ্ট’ হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারছে না কংগ্রেস শিবির।