ব্রিগেডের মঞ্চে আব্বাস সিদ্দিকি। নিজস্ব চিত্র।
এত দিন জোটের মধ্যে আসন-রফার আলোচনায় তাঁর কথা শোনা যাচ্ছিল। এ বার একেবারে ব্রিগেড সমাবেশের মঞ্চে আলো টেনে নিলেন আব্বাস সিদ্দিকি। সেই সঙ্গেই নতুন করে চর্চা শুরু হল রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের সমীকরণ নিয়ে।
সরাসরি ভোটের সমীকরণের প্রসঙ্গে না গিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি এই ব্রিগেডের পরে বামেদের বিরুদ্ধে ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস’ করার অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে।
পাশাপাশি বাম ও কংগ্রেস নেতৃত্বের যুক্তি, তাদের নিজেদের আসন জিততেও সংখ্যালঘু ভোটে নজর দিতে হবে। আব্বাসদের সঙ্গে নিলে সেই লড়াই শক্তিশালী হবে। কার ভোট কোথায় কাটবে, সে পরের কথা।
বিধানসভা ভোটের আগে রবিবার বিরোধী জোটের ব্রিগেডে যে ভিড় মাঠ ভরাল, তার মধ্যে আব্বাসের ‘অবদান’ ছিল দৃশ্যতই স্পষ্ট। তাঁর দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। ব্রিগেডে জমায়েতে আব্বাসের সমর্থক ২৫-৩০ বছরের তরুণদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। ফুরফুরা শরিফের ‘ভাইজান’কে নিয়ে উচ্ছ্বাস এমনই যে, মঞ্চে তাঁর প্রবেশের সময়ে মাঠের হইচইয়ে কিছু ক্ষণ বক্তৃতা থামিয়ে দিতে হয় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা অধীর চৌধুরীকে।
আবার আব্বাসের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরেই সমাবেশ ছেড়ে বর্হিমুখী স্রোতও দেখা গেল । বিজেপি ও তার ‘বি টিম’ তৃণমূলকে পরাস্ত করে বিকল্প শক্তির সরকার আনার ডাক দেওয়ার পাশাপাশি আব্বাস কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে খোঁচা রেখে বলে গেলেন, যে সব আসনে বাম শরিক দলের প্রার্থী থাকবে, সেখানে ‘বুকের রক্ত’ দিয়ে তাঁরা ‘মাতৃভূমিকে মুক্ত’ করার লড়াই করবেন।
আব্বাস ও তাঁর নতুন দল আইএসএফের এ দিনের ভূমিকা দেখার পরে রাজনৈতিক শিবিরের অনেকের প্রশ্ন, বাম ও কংগ্রেসের জোটে বাড়তি শক্তি জোগানোর পাশাপাশি যে ভোট আব্বাসেরা পেতে পারেন, তা আসবে কার বাক্স ভেঙে? সে ক্ষেত্রে কি মেরুকরণের অঙ্কে সংখ্যালঘু ভোটে আব্বাসদের ভাগ আসলে তৃণমূলের সমর্থনে ভাঙন ধরাতে পারে? প্রকারান্তরে তাতে কি উল্টো দিকের মেরুকরণ করে ‘লাভ’ হতে পারে বিজেপি-র?
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘এই ব্রিগেড নিয়ে আলোচনা আসলে সময় ও রুচির অপচয়। তবে লাল ঝান্ডা এ ভাবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দেখলে গ্লানিবোধ হয়। বাংলার মানুষ একটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলা করছেন, অন্য মৌলবাদী চেষ্টাকেও তাঁরা প্রত্যাখ্যান করবেন।’’ আর বাম ও কংগ্রেসের প্রতি তৃণমূলের নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের কটাক্ষ, ‘‘নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারা দু’টো লোক পরস্পরের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছিল, এখন একটা ক্রাচ জোগাড় করল!’’
একই সুর বিজেপি নেতাদেরও। শুভেন্দু অধিকারী, শমীক ভট্টাচার্যের মতো বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, এই ব্রিগেডের পরে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আর বাম বা কংগ্রেসের মুখে মানায় না। শুভেন্দুর মন্তব্য, ‘‘বামপন্থীরা পাশে আব্বাস সিদ্দিকিকে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলবেন!’’
এমন আক্রমণ উড়িয়ে সিপিএম নেতৃত্বের পাল্টা বক্তব্য, ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আব্বাস-সহ সব বক্তাই বলেছেন মানুষের হক বুঝে নেওয়ার কথা। ডাক দিয়েছেন সরকার বদলের। অনগ্রসরদের উন্নয়নের কথা বলার মধ্যে মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতা এল কোথায়? সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘গ্রামেগঞ্জে বা শহরে ক্ষুব্ধ মানুষ বুঝতে পারছেন, তৃণমূলের বিদায় আসন্ন। তৃণমূলকে দিয়ে বিজেপির মোকাবিলা হবে না। বাংলায় যাতে বিজেপি চেপে বসার সুযোগ না পায়, তার জন্য বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফের জোট লড়াই করবে। বিজেপি ও তৃণমূল, উভয় পক্ষই নিজেদের বিপদ বুঝতে পারছে বলে এমন আক্রমণ করছে।’’ আব্বাসের সঙ্গে থাকা তরুণ শক্তি বুথ স্তরে লড়াইয়ে কাজে আসবে বলেও তাঁদের আশা।
ব্রিগেডের সমাবেশে এ দিন বামেদের ভূয়সী প্রশংসাই শোনা গিয়েছে আব্বাসের মুখে। বিজেপির ‘কালো হাত ভেঙে দেওয়া’ এবং তাদের ‘বি টিম’ তৃণমূলকে উৎখাত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে শূন্য করে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন তিনি। আব্বাস বলেছেন, ‘‘আমরা যেমন ভাবে আসন চেয়েছিলাম, তার বেশির ভাগই মেনে নিয়ে বামেরা আমাদের ৩০টা আসন দিয়েছেন। ত্যাগ স্বীকার করে সদিচ্ছা দেখিয়েছেন। যেখানে বাম শরিক দলের প্রার্থী থাকবে, সেখানে বুকের রক্ত দিয়ে আমরা মাতৃভূমিকে মুক্ত করব। জান দিয়ে লড়াই করব। দুর্নীতি, অপশাসনমুক্ত বাংলা গড়ব।’’ কংগ্রেসকে হুঁশিয়ারি দিয়েও আব্বাস বলে রেখেছেন, বন্ধুত্ব চাইলে তাদের জন্যও দরজা খোলা আছে। জোট হলে কংগ্রেসের জন্যও তাঁরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করবেন।
জোট এবং ভিড়কে এক সূত্রে গেঁথে এ দিন আব্বাসের আরও দাবি, ‘‘জোটটা আগে হয়ে গেলে এর দ্বিগুণ লোক আমরা আনতাম!’’