ওয়াসিম আক্রম। — নিজস্ব চিত্র।
দুর্ঘটনায় আহত বছর উনিশের যুবককে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে। আঘাত পায়ে, কিন্তু অভিযোগ, সেখানে ওই যুবককে দেখে ক্ষতস্থান সেলাই করে কয়েকটি ওষুধ লিখে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন এক দন্ত চিকিৎসক। তাতে চোট তো সারেইনি, উপরন্তু পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, শেষমেশ প্রাণ বাঁচাতে কেটে বাদ দিতে হয়েছে ওই যুবকের একটি পা!
শুধু চিকিৎসায় গাফিলতির এমন অভিযোগেই বিষয়টি মিটে যায়নি। গাফিলতির অভিযোগ ঘিরে যে তদন্ত প্রক্রিয়া, তা নিয়েও এ বার উঠতে শুরু করেছে প্রশ্ন। প্রশ্নের মুখে স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন প্রচারও। অনেকেই বলছেন, ব্লক স্তর পর্যন্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার দাবি করে সরকার। এই যদি সেই পরিষেবার নিদর্শন হয়, তা হলে তো সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন হবে তার উপরে ভরসা রাখাই।
চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ এবং এ নিয়ে রাজ্যের দুই মেডিক্যাল কলেজের ভিন্ন রিপোর্ট নিয়ে এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘আমরা এ বিষয়ে অবগত। সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গাফিলতি প্রমাণিত হলে, যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
মালদহের রাজনগর গ্রামের বাসিন্দা ওয়াসিম আক্রম গত ২৬ ডিসেম্বর মোটরবাইক চালাতে গিয়ে পায়ে চোট পান। অভিযোগ, ইংরেজবাজার ব্লকের মিল্কি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে বহির্বিভাগে থাকা চিকিৎসকের পরামর্শ মতো শুধু ক্ষতস্থানে সেলাই করা হয়। এর পরে কয়েকটি ওষুধ লিখে ছেড়ে দেন ওই দন্ত চিকিৎসক। এমনকি, প্রেসক্রিপশনের ‘ক্লিনিক্যাল নোট’ কলামে আঘাত বা সেলাইয়ের উল্লেখ করেননি। তরুণের মা শাহেনারা বিবি জানাচ্ছেন, ২৬ ডিসেম্বর দুপুর থেকেই পা ফুলতে শুরু করে এবং যন্ত্রণা হতে থাকে। পরের দিন দুপুর থেকে পায়ের পাতার ক্ষতস্থান, গোড়ালি ক্রমশ কালো হয়ে পচা গন্ধ বেরোতে শুরু করে।
২৮ ডিসেম্বর ফের ওই ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে, এক মেডিক্যাল অফিসার পরীক্ষা করে, মালদহ মেডিক্যাল কলেজে রেফার করেন। তবে, সেই প্রেসক্রিপশনে ক্লিনিক্যাল নোটে আঘাত-সহ নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়। এক্স-রে করার পরামর্শ দেওয়া হয়। শাহেনারার অভিযোগ, ‘‘প্রথম দিনই অনুরোধ করেছিলাম, হাড় ভেঙেছে কি না, তা এক্স-রে করে দেখার জন্য। কিন্তু ‘এখানে এ সব হয় না’ বলে ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়।’’ জানা যাচ্ছে, মিল্কি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক্স-রে যন্ত্রই নেই। মালদহ মেডিক্যালে না গিয়ে ২৯ ডিসেম্বর ওয়াসিমকে নিয়ে কলকাতায় আসেন পরিজনেরা।
মধ্যমগ্রামের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি হলে, এক্স-রে করে দেখা যায়, ওয়াসিমের ডান পায়ের পাতার হাড় ভাঙার পাশাপাশি বিভিন্ন টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মাংসপেশিতে পচন ধরে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। ৩০ ডিসেম্বর ওয়াসিমের হাঁটুর নীচ থেকে কেটে বাদ দেন চিকিৎসকেরা। ছেলের এমন অবস্থার জন্য চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে ১৫ জানুয়ারি জেলাশাসক, জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি দেন শাহেনারা। তার পরে মালদহ মেডিক্যাল কলেজের সুপারকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। পাঁচটি বিভাগের চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত কমিটি ৯ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট দিয়ে দাবি করে, চিকিৎসায় গাফিলতি বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ মেলেনি!
ওই রিপোর্টের বিরোধিতায় নিরপেক্ষ তদন্তের আর্জি নিয়ে ৮ এপ্রিল হাই কোর্টে মামলা দায়ের করে ওয়াসিমের পরিবার। তাঁদের আইনজীবী নিগম আশিস চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য নির্দেশ দেন, মালদার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ফের নিরপেক্ষ তদন্ত করুন। প্রয়োজনে এসএসকেএম-কে দিয়ে তা করাতে পারেন।’’ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের অনুরোধে এসএসকেএম-এর অস্থি, প্লাস্টিক সার্জারি ও সিটিভিএস বিভাগের চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত কমিটি ১২ জুন অভিযোগকারীএবং অভিযুক্তদের নিয়ে বসেন। কিন্তু সেখানে ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক উপস্থিত না থাকায় ফের তাঁকে তলব করে ২৬ জুন সব পক্ষের কথা শোনে কমিটি। সূত্রের খবর, সেখানেও প্রশ্ন ওঠে, আঘাতের ঘটনায় কেন প্রথমেই এক্স-রে করা হয়নি? নিগমাশিস বলেন, ‘‘ক্ষত সেলাই করা হলে তা রেজিস্ট্রারে নথিভুক্ত করতে হয়। সেটাও ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঠিক মতো ছিল না। আদালতে মামলা করে পিজি-র রিপোর্টও জানতে চাইব।’’ সূত্রের খবর, পিজি-র বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট মালদহের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কোর্টে জমা দেবেন।
ওয়াসিম বা তাঁর পরিবার এ নিয়ে লড়াই ছাড়তে নারাজ। এক পা হারিয়েও এ বার প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে ওয়াসিম। ছেলেকে আঁকড়ে শাহেনারা বলছেন, ‘‘ক্ষতিপূরণ নয়। দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত থামব না।’’