জামতাড়া থানায় প্রথম সাইবার মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের হয় ২০১১ সালে। প্রতীকী ছবি।
আগে থেকে কথা হয়েছিল। পঞ্চায়েত সদস্যটি অপেক্ষা করছিলেন পুলিশ অফিসের সামনে। কাছেই সদর প্রশাসনিক ভবন।
এই পঞ্চায়েত সদস্যটিই জীবন্ত পরিচয়পত্র। বা বলা যায়, যে ঊষর এলাকায় এর পরে ঢোকার কথা, সেখানে সব ধরনের বাধা খোলার চাবিকাঠি। আরও এক জন ছিলেন। তিনি সাইবার অপরাধ দমন শাখার ডিএসপি মজরুল হোদা। তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। তিনিই বলে রেখেছিলেন ঠিক ঠিক জায়গাগুলিতে।
সকালে আসানসোল থেকে ১৯ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এসে রূপনারায়ণপুর রেলসেতু, তা পার হয়ে বিহার রোড ধরে, রাজ্যের সীমানায় চেকপোস্টটি পিছনে ফেলে ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে সিধে জামতাড়া। পুলিশ অফিসের সামনে পঞ্চায়েত সদস্যটিকে যখন মোটরবাইকে তোলা গেল, সকাল তখন সাড়ে ন’টা।
গন্তব্য জামতাড়ার ‘অন্দরমহল’। বা বলা ভাল, গত এক যুগ ধরে যে সাইবার অপরাধ গোটা দেশকে কাঁপিয়ে চলেছে দিনের পর দিন, তার উৎসস্থলে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বললেই জানা যায়, এলাকাটি অন্তরে কতটা অপরাধপ্রবণ। এলাকার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে মনে হবে, ঝাড়খণ্ডের চম্বলে এসে পৌঁছেছেন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, এখান থেকেই আপনার কাছে কখনও ব্যাঙ্কের নামে ভুয়ো ফোন যায়, কখনও বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার নামে যায় ভুয়ো মেসেজ। যেখানে আপনি ওটিপি দিলে বা লিঙ্কে ক্লিক করলেই অ্যাকাউন্টের দরজা ‘চিচিং ফাঁক’।
পঞ্চায়েত সদস্য বলছিলেন, ‘‘এখানে আগে চলন্ত ট্রেনে যাত্রীদের মাদক মেশানো খাবার বা পানীয় দিয়ে অজ্ঞান করে সব লুট করা হত। তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছয়। কয়েক জনের প্রাণ যায়। খানাতল্লাশি চলে। তত দিনে হাতে হাতে মোবাইল এসে গিয়েছে। অপরাধের পথও অন্য দিকে বেঁকে যায়।’’
জামতাড়ার কাছেই নারায়ণপুর ও কর্মাটাঁড়। কর্মাটাঁড়েই শেষ জীবন কাটান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সেই জায়গাই এখন সাইবার প্রতারণার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। পঞ্চায়েত সদস্য মৃদু হেসে বললেন, ‘‘বিদ্যাসাগরের কথা আর এখন আলোচনা না করাই ভাল।’’ জানা গেল, সাইবার অপরাধের পিছনে রয়েছে এমন সব মাথা, যারা হয়তো এখনও সাবালকই হয়নি। বলা যেতে পারে, তাদেরই কণ্ঠস্বরে আপনি কখনও ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে পান, কখনও কলসেন্টারের কোনও মহিলা কর্মীকে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জামতাড়া থানায় প্রথম সাইবার মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের হয় ২০১১ সালে। সে বারে ধৃত ব্যক্তি জামতাড়ার এক পুলিশ আধিকারিককে শুনিয়েছিল তার প্রতারণার ধরন। ওই আধিকারিকের কথায়, ওই প্রতারক নিজেকে ব্যাঙ্ক আধিকারিক পরিচয় দিয়ে ওড়িশার এক ব্যবসায়ীকে ফোন করে। পেশাদার আধিকারিকের মতোই সে ব্যবসায়ীকে বলে, তাঁর ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ডটি কিছুক্ষণের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এটিএমের পিন জানালে, তারা সেটি চালু রাখার ব্যবস্থা করবে। কথার ফাঁদে পড়ে ব্যবসায়ী প্রতারকটিকে এটিএমের পিন দেন। নিমেষে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে লক্ষাধিক টাকা তুলে নেওয়া হয়। ওই প্রতারকের কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত কিছু টাকা উদ্ধার করেছিল পুলিশ।
এক যুগ আগের সে ঘটনা এখন ‘প্রাচীন ইতিহাস’ বলা যায়। পুলিশ-প্রশাসনের দেশ জুড়ে লাগাতার প্রচারে এখন মানুষ তুলনায় সচেতন। ফলে জামতাড়াকেও বদলাতে হয়েছে প্রতারণার পদ্ধতি। যেমন ধরা যাক, আচমকা মোবাইলে একটি মেসেজ এল: ‘আপনার বিদ্যুতের বিল বাকি পড়েছে। তাই সংযোগ কেটে দেওয়া হবে। সংযোগ রাখতে চাইলে নীচের লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।’ সেখানে ক্লিক করলে ফোনে একটি ওটিপি আসবে। প্রতারক এর পরে ছলেবলে সেটি জেনে অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেবে। অনেক সময়ে আবার প্রতারকেরা তাদের ‘শিকারকে’ মোবাইল ফোনে এমন কিছু অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করতে বলে, যার মাধ্যমে তারা ফোনটি ‘হ্যাক’ করতে পারে। ফল সেই এক, অ্যাকাউন্ট ফাঁকা। পুলিশ জানাচ্ছে, কখনও গরিব চাষিদের পশুখাদ্য সরবরাহের লোভ দেখিয়ে, কখনও গ্রামের বেকারদের ঋণের টোপ দিয়ে অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বেশ কিছু ক্যুরিয়র প্রাপককে তাঁর সামগ্রী একটি জায়গায় আটকে গিয়েছে, ফোনে পাঠানো লিঙ্কে ক্লিক করলে সেটি আবার রওনা করানো যাবে— এমন টোপ দিয়ে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনাও সামনে এসেছে।
পুলিশই জানাচ্ছে এই সব তথ্য। কিন্তু ধরতে পারছে না। প্রতারণার বিবর্তন ঘটিয়ে সব সময়েই কয়েক কদম এগিয়ে থাকছে জামতাড়া।
(চলবে)