সালটা অষ্টাদশ শতকের ছয়-সাতের দশক। এলিজাবেথ অ্যান লিনলে নামে এক সুন্দরী মহিলাকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত বাগ্মী রিচার্ড ব্রিন্সলি শেরিডন ও তাঁর বন্ধুর লড়াই শুরু হল। শেষমেশ এলিজাবেথ বেছে নিলেন শেরিডনকেই।
আর বন্ধুটি? মনের দুঃখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে চলে এলেন ভারতবর্ষে। সেটা ১৭৭২ সাল। বছর ২২-এর সেই ইংরেজ যুবকের ভারত-আগমন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই সঙ্গে তৈরি হল বাংলা মুদ্রণ শিল্পের জয়যাত্রার প্রথম সোপান। ইংরেজ যুবকটির নাম নাথানিয়াল ব্রাসি হালেদ। ১৭৭৮ সালে তাঁর লেখা ‘এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ প্রকাশিত হয়।
এই বইটির সাফল্য মূলত ৩টি জায়গায়। প্রথমত, এটি বাংলা হরফে ছাপা প্রথম বই। দ্বিতীয়ত, পুঁথির জগৎ পেরিয়ে বাংলা কবিতা এই বইতেই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। তৃতীয়ত, এই বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রথম সঞ্চালনযোগ্য বাংলা মুদ্রাক্ষরের জন্মদাতার নাম। তিনি চার্লস উইলকিনসন।
হালেদ ব্যাকরণ তো লিখে ফেললেন। কিন্তু ছাপা হবে কী ভাবে? ছাপাখানাতে বাংলা হরফই যে নেই। হালেদ সাহায্য চাইলেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে। হেস্টিংস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক রাইটারের কথা শুনেছিলেন। সেই রাইটার নাকি খেলাচ্ছলে ছেনি হাতে দু-একটা বাংলা হরফ তৈরি করেছিলেন। ডাক পড়ল সেই রাইটার উইলকিনসনের। উইলকিনসন তখন হুগলির কুঠিতে হালেদের সহকর্মী। সব শুনে উইলকিনসন তো মহাখুশি। বসে পড়লেন হরফ তৈরির কাজে। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন এক বাঙালি কারুশিল্পী। নাম পঞ্চানন মল্লিক (যিনি ‘কর্মকার’ উপাধিতেই বেশি পরিচিত)।
অল্প সময়ের মধ্যে সাফল্য পেলেন উইলকিনসন। হুগলির বাসিন্দা এনড্রুজ নামে এক বই বিক্রেতার ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হল বাংলা ছাপার হরফে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ ‘এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’। আটপেজি আকারের মূল বইটি ২৪৮ পাতার। বাংলা ব্যাকরণের প্রাথমিক বিষয়গুলি মোট ৮টি অধ্যায়ে সাজিয়েছেন হালেদ।
তবে বই ছাপার জন্য বাংলা হরফ তৈরির কাজ সহজে এগোয়নি। ১৬৬৭ সালে আমস্টারডাম থেকে ‘চায়না ইলাস্ট্রেটা’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়, যেখানে বাংলা হরফের নমুনা মেলে। এরপর ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি লাতিন বইতেও বাংলা লিপির নিদর্শন দেখা যায়। কিন্তু এ সব নিদর্শনই ব্লক বা প্লেটের সাহায্যে ছবির মতো করে ছাপা। কোনওটিই ধাতুর অক্ষর তৈরি করে ছাপা নয়। একটি হিসেব থেকে জানা যায়, প্রথম যুগের বাংলা মুদ্রণের জন্য প্রায় এক হাজার হরফের দরকার পড়ত। উইলিয়াম বোল্টস নামে এক পণ্ডিত চেষ্টা করেছিলেন বাংলায় টাইপ তৈরি করার। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন।
দীর্ঘ নীরবতার পর ফের এই ঐতিহাসিক বইটির একটি সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বইটির সম্পাদনা করেছেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন রবীন্দ্র-অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য ও রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের প্রাচ্যবিদ্যার গবেষণা-অধ্যাপক নিখিলেশ চক্রবর্তী। সংস্কৃত, বাংলা ভাষার ব্যাকরণগত ত্রুটি এবং মুদ্রণ ভুল-হালেদের মূল বইটির এই ৩ ধরনের প্রমাদ যত্ন নিয়ে সংশোধন করা হয়েছে এই সংস্করণে। তবে বইয়ের আসল পাঠটি একেবারেই অবিকৃত রাখা হয়েছে। কলকাতার ‘আশাদীপ’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সংশোধিত সংস্করণকে ৩টি পর্বে সাজিয়েছেন সম্পাদকেরা। নতুন করে বইটির প্রকাশের পর সম্পাদকদের আশা, “এই সংস্করণ বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাস চর্চায় বিশেষ ভাবে কাজে লাগবে।”