তিথি মণ্ডল।
গ্রামের নাম কুমিরমারি। কুমির শুধু নামেই নেই, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে সত্যিকারের কুমিরও আছে দেদার। ও-পারেই সুন্দরবনের জঙ্গল। নদী পেরিয়ে গ্রামে বাঘ ঢোকে হামেশাই। উপরন্তু সর্বদা হাঁ করে আছে অভাবের বাঘ আর অনটনের কুমির। এত সব বাঘ-কুমিরের সঙ্গে নিত্য লড়াই করেই তিথি মণ্ডল ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক। আর ঘুগনি-ফুচকা বেচে সেই মেয়েকে পড়িয়েছেন মধুসূদন মণ্ডল। গ্রামের যে-পুজো মণ্ডপে বাবা ঘুগনি বিক্রি করছেন, সেই মণ্ডপেই আজ, বুধবার বিজয়া দশমীতে তাঁর কৃতী মেয়ের সংবর্ধনা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রাম কুমিরমারির একটি পুজো মণ্ডপকে বিজয়া দশমীতে মেধাবী ছাত্রীর সংবর্ধনা মঞ্চ হিসেবে বেছে নেওয়ার মধ্যে এক অন্যতর বোধনের ইঙ্গিত মিলছে। তিথির হাত ধরে নারীশক্তির বোধন। সোনারপুর কলেজে পড়ে শিক্ষিকা হতে চান তিথি। সেই ভাবী শিক্ষিকার পথ চলারও বোধন আজ।
তিথির বাবা মধুসূদন কয়েক বছর আগে একটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তার পর থেকে তিনি আর কোনও রকম ভারী কাজ করতে পারেন না। হতদরিদ্র মধুসূদন এখন গ্রামে ঘুরে ঘুরে ঘুগনি আর ফুচকা বিক্রি করেন। এ বার মহোৎসবেও গ্রামের একটি পুজো মণ্ডপে ঘুগনি বিক্রি করছেন তিনি। সেই মণ্ডপেই সংবর্ধনা পাচ্ছেন তাঁর মেয়ে। মধুসূদন বলেন, ‘‘আমার একমাত্র মেয়ে তিথি। মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে অনেক স্বপ্ন। বলে, স্কুলের দিদিমণি হবে। কিন্তু ওর পড়ার খরচ জোগাব কী করে? ঘুগনি আর ফুচকা বিক্রি করে কি মেয়ের পড়ার খরচ চালানো যায়? তা-ও আবার মেয়ে পড়তে চায় শহরের কলেজে।’’
মেয়ের পড়ার খরচের একটা সুরাহা হচ্ছে আজই। কুমিরমারি হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রণয় মণ্ডল জানান, তাঁদের অধিকাংশ পড়ুয়াই হতদরিদ্র পরিবারের। দারিদ্র আর বাঘ-কুমিরে পরিপূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করেই এখানকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করে বড় হতে হয়। প্রণয় বলেন, ‘‘আমাদের এক প্রাক্তনী কৌস্তুভ মণ্ডলের মা নদী থেকে বাগদা পোনা তুলে সংসার চালাতেন। সেই কৌস্তুভ এখন কলেজে পড়ায়। কৌস্তুভই প্রস্তাব দেয়, স্কুলের প্রাক্তনীদের একটি সংগঠন তৈরি করে এখনকার হতদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের যদি সাহায্য করা যায়।’’ প্রণয় জানান, প্রস্তাব শুনেই তিনি রাজি হয়ে যান। তিনি নিজেও এই স্কুলের প্রাক্তনী। স্কুলের অন্য যে-সব প্রাক্তনী বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি প্রাক্তনী সংগঠন তৈরি করেছেন তিনি। ঠিক করেছেন, উচ্চ মাধ্যমিকে তাঁর স্কুল থেকে যে প্রথম হবে, তার কলেজের পড়াশোনার খরচের কিছুটা ভার বহন করবেন তাঁরা। এ বার ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে স্কুলে প্রথম হয়েছেন তিথি। তাঁর কলেজে পড়ার মাসিক খরচের একাংশ প্রক্তানীরা দেবেন। অমরেশ, অনিমেষ, বিপ্লব, শ্যামলীর মতো বেশ কিছু প্রাক্তনী ইতিমধ্যে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন।
কুমিরমারি স্কুলের শিক্ষকেরা জানান, পুজোর ছুটি চলছে। তাই স্কুলে সংবর্ধনার আয়োজন করে আর্থিক সাহায্য দেওয়া যাবে না। সেই জন্য পাড়ার ক্লাবের পুজো মণ্ডপকেই আজ, বুধবার সংবর্ধনার মঞ্চ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। সংবর্ধনার সঙ্গে সঙ্গে অর্থসাহায্যও দেওয়া হবে তিথিকে।
পুজো শেষ হয়ে যাওয়ায় তিথির একটু মনখারাপ। তবে স্বীকৃতি আর সাহায্য নতুন উদ্দীপনাও জোগাচ্ছে বলে জানালেন তিথি। বললেন, ‘‘ইতিহাসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি সোনারপুর কলেজে। সোনারপুরে থেকে পড়তে গেলে তো থাকার খরচও আছে। সেই খরচ আমি টিউশন করে জোগাড় করব। পড়াশোনার খরচটা যে স্কুলের প্রাক্তনী দাদা-দিদিরা দিচ্ছে, এতে আমি খুব খুশি। অনেকটা চিন্তামুক্ত হতে পারছি।’’