Harmony

আরবি-ফারসি-উর্দুর মায়ায় সম্প্রীতির আহ্বান

সাধারণত ‘মুসলিমদের ভাষা’ তকমাবাহী আরবি, ফারসি ও উর্দুকে অনলাইনে সব বাঙালির কাছে মেলে ধরতে একটি উদ্যোগ এখানে শুরু হচ্ছে।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২০ ০২:৩২
Share:

শাহজাহানের আমলে সংস্কৃত থেকে ফার্সিতে অনুদিত অশ্বচরিত কথা।

দারাশুকোকে নিয়ে উপন্যাস লেখার সময়ে টালিগঞ্জের এক প্রবীণ ফারসি শিক্ষকের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। মধ্যযুগের বাঙালির বৌদ্ধিক চর্চা থেকে উপনিবেশ যুগের লোকায়ত সংস্কৃতির সন্ধানেও পদে পদে ফারসি, আরবি শব্দ-রহস্যের টানে মজেন ইতিহাস পড়ুয়ারা।

Advertisement

কয়েক বছর আগে বসিরহাট স্টেশনে দাঁড়িয়ে আরবির শিক্ষক আলি কাশমিও রেলের ঘোষণা শোনেন, হাসনাবাদ থেকে শিয়ালদহ যাওয়ার গাড়ি বাতিল হয়েছে। তিনি রীতিমতো চমৎকৃত, আরে এই ‘বাতিল’ তো আরবিতেও রয়েছে। কোভিড-আবহে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে এই সব বিস্মৃত বিষয়কে ঝালিয়ে নেওয়ার উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। সাধারণত ‘মুসলিমদের ভাষা’ তকমাবাহী আরবি, ফারসি ও উর্দুকে অনলাইনে সব বাঙালির কাছে মেলে ধরতে একটি উদ্যোগ এখানে শুরু হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে ফারসি, আরবি যে ভাবে মিশে তাতে, তা স্রেফ বাঙালি মুসলিম নয়, সব বাঙালিরই শিকড়ের একটি দিক বলে মনে করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি ইতিহাসের প্রবীণ শিক্ষক অমিত দে-ও। তিনি বলেন, “কত ফকিরি, মারফতি গান জু়ড়েও আরবি, ফারসির মায়া। রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ-ঘনিষ্ঠ ক্ষিতিমোহন সেনেরা তা বুঝতেন। ইতিহাসের বাঁকে দ্বিজাতি তত্ত্ব থেকেই আরবি, ফারসি নিয়ে এই বাংলায় ছুতমার্গের শুরু।” মোটে দু’দশক আগে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষও তাঁর সঙ্গীত জীবন নিয়ে বইয়ের নাম রাখেন, তহজীব-এ-মৌসিকী (সঙ্গীত-সংস্কৃতি)। কিন্তু কলকাতায় বিভিন্ন ভাষাচর্চার শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা, ইদানীং উর্দু, ফারসি শেখার প্রবণতা কম। উপসাগরে চাকরির টানে কেউ কেউ আরবি শিখতে চান। তাও অমুসলিমদের আগ্রহ কম।

কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় বিচ্ছিন্নতা কাটানোর একটি উদ্যোগ ‘নো ইয়োর নেবার’-এর উদ্যোক্তারা এ বার অনলাইনে আরবি, ফারসি ও উর্দু শেখানোর পাঠক্রম চালু করছেন। বিষয়টিতে উৎসাহিত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষিকা ঈপ্সিতা হালদার। বলছেন, “বাংলায় উলেমাদের লেখা, মহরমের সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা-পর্বে আমিও আরবি শেখার চেষ্টা করেছি। গোলপার্কের ইনস্টিটিউট অব কালচারে আরবি ক্লাসও করি। এই করোনাকালে, অনলাইন শেখার সুযোগ হলে ভালই।”

Advertisement

আয়োজনটির শরিক মৌলানা আবুল কালাম আজ়াদ কলেজের ফারসির বিভাগীয় প্রধান ইফতেকার আহমেদ হাসছেন, “ফারসির কাগজ, কলম, দলিল, দাবি– সবই তো বাংলায় মিশে। ইসলামি সংস্কৃতি নিয়ে নানা ভুল ধারণা (ইসলামোফোবিয়া) কাটাতেও ভাষাই হাতিয়ার।” উনিশ শতকীয় কৃষক আন্দোলন নিয়ে তাঁর বই ‘ইমান ও নিশান’-এও জিহাদ শব্দের ব্যঞ্জনার রকমফের বোঝান গৌতম ভদ্র। ‘কোরানে বহু জায়গায় অন্তরের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জেহাদ করতে বলা হয়েছে।’ তবে কলকাতার কোনও কোনও শিক্ষক দিল্লি যাওয়ায় ফারসি-চর্চা একটু ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করেন ‘দ্য সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর শিক্ষক রাজর্ষি ঘোষ।

এ যাত্রায়, ছ’মাসের তিনটি আলাদা পাঠক্রমে সব মিলিয়ে একশোরও বেশি নাম লিখিয়েছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের এমফিল গবেষক পারমিতা পুরকায়স্থ ভবিষ্যতে মধ্যযুগ নিয়ে চর্চার ইচ্ছায় ফারসি পড়বেন। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী রুদ্রাণী দাশগুপ্ত বলছেন, “কখনও সিরিয়া যেতে পারি ভেবেই আরবি শেখার এত ইচ্ছে। সেখানে কাজ করলে তো ভাষা জানাটা কাজে দেবেই।”

জুলাইয়ের শেষে ক্লাস শুরুর কথা। তার আগে সম্প্রতি ওয়েব-আড্ডায় শামিল হয়েছিলেন উর্দু বিশারদ মেহতাব আলম, সাবিহা সৈয়দেরা। ‘হাত মিলে না মিলে, দিল মিলায়ে রাখিয়ে’ বলে কঠিন সময়ে ভাষাবন্ধনে দূরত্ব-কাঁটা জয়ের ডাক দিচ্ছেন ইফতেকার সাহেব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement