এনআরসি-র আতঙ্কে সত্তরের বৃদ্ধও বিয়ের অফিসে!

এনআরসি আতঙ্কে ভুগছে গোটা রাজ্য। পরিস্থিতি ঘুরে দেখল আনন্দবাজারবহু বছর আগে কলমা পড়ে নিকাহ হয়েছিল। কাগজে-কলমে কোনও নথি নেই। এনআরসি-র ফলে বুড়ো বয়সে স্বামী-স্ত্রীর হাঁড়ি আলাদা হবে না তো? ভয় চেপে বসেছে আখতারের মনে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৩:৩৯
Share:

ছবি: এপি।

সত্তর ছুঁইছুঁই স্ত্রীকে নিয়ে ভাঙড়ের আখতার আলি ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে এসেছেন বিয়ে করতে।

Advertisement

বহু বছর আগে কলমা পড়ে নিকাহ হয়েছিল। কাগজে-কলমে কোনও নথি নেই। এনআরসি-র ফলে বুড়ো বয়সে স্বামী-স্ত্রীর হাঁড়ি আলাদা হবে না তো? ভয় চেপে বসেছে আখতারের মনে।

শুধু আখতার নন, ভাঙড় ১ ব্লকের এক ম্যারেজ রেজিস্ট্রার জানালেন, মাসখানেকের মধ্যে খাতায়-কলমে বিয়ে সারতে আসা দম্পতির সংখ্যা অন্তত পঞ্চাশ। কারও কারও দাম্পত্যের বয়স বিশ-তিরিশ বছরের বেশি। এনআরসি-র ভয়ে নাতিপুতি নিয়ে এখন আসছেন বিয়ে করতে।

Advertisement

ইতিমধ্যে বসিরহাট মহকুমায় জনা পাঁচেকের মৃত্যু হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ, এনআরসি নিয়ে আতঙ্কে ভুগছিলেন তাঁরা। নথিপত্র ঠিকঠাক ছিল না। গত কয়েক দিনে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে যে ভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তাতে বিষয়টা আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নেই। দেগঙ্গায় দিন কয়েক আগে এনআরসি নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে মুসলিমরা ছাড়াও কয়েকটি হিন্দু সংগঠনের লোকজনও ছিলেন। ঠিক হয়েছে, যে ভাবে হোক, এনআরসি রুখতেই হবে।

উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাংলাদেশ সীমান্ত। অনুপ্রবেশ ঘটে আকছার। নথির খোঁজে এখন মাথার ঘাম পায়ে পড়ার জোগাড় অনেকের। শুধু তো রেশন কার্ড, আধার কার্ড নয়। দীর্ঘ দিন ধরে এ দেশে বসবাসের কিছু একটা দলিল দরকার। তাই পুরনো বাক্স-পেঁটরা খুলে উলটপালট করছেন হাড়োয়ার ইয়ার আলি বিশ্বাস। ছাপোষা চাষি। আইনকানুন তেমন বোঝেন না। এনআরসি নিয়ে প্রশ্ন শুনে উগরে দিলেন পাঁচটা শোনা কথা। বললেন, ‘‘শোনেননি, এ বার এরা দেশছাড়া করবে। মস্ত পাঁচিল ঘেরা এনআরসি-বাড়ি তৈরি হয়েছে। হাজার হাজার লোক থাকবে সেখানে। মরদ-মেয়ে আলাদা আলাদা। আরও বাড়ি তৈরি হচ্ছে।’’ আরও যোগ করলেন, ‘‘১৯৭১ সালের দলিল না থাকলে সবাইকে পাঠানো হবে সেখানেই। কিছু দিন সেখানে রেখে শ্রমিকের কাজ করিয়ে বাংলাদেশে চালান করা হবে!’’

বোঝা গেল, গুজব কতটা ডালপালা মেলেছে।

উত্তর ২৪ পরগনার বাংলাদেশ ঘেঁষা বসিরহাট, হাড়োয়া, বাদুড়িয়া, দেগঙ্গা, মিনাখাঁ সর্বত্রই প্রায় চিত্রটা এক। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে একই আলোচনা। সকলেই সকলকে পরামর্শ দিচ্ছেন, কাগজপত্র গুছিয়ে রাখো। না হলে নিস্তার নেই। সে সব শুনে মুদিখানা দোকানের হালখাতার নেমন্তন্নের জরাজীর্ণ কার্ডও চামড়ার সুটকেস থেকে ঝেড়েঝুড়ে বের করে রেখেছেন দেগঙ্গার খাদিনা বিবি। যদি কোনও কাজে লাগে!

এ বঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি চালু হবে, সে কথা তো প্রশাসন বলেনি— কথাটা শেষ করতে না করতেই হইহই করে উঠল দেগঙ্গা ব্লক অফিসে রেশন কার্ড সংশোধন করতে আসা ভিড়টা। ‘‘চালু যে হবে না, সে কথাও কি কেউ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে?’’ উড়ে এল পাল্টা প্রশ্ন। কলেজপড়ুয়া সানি বিশ্বাস বললেন, ‘‘দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানে এনআরসি-র কথা বলছেন, সেখানে আর কার কথায় ভরসা রাখব?’’

গাঁয়ে-গঞ্জে আতঙ্ক যে ছড়িয়েছে, মানছেন দেগঙ্গার বিডিও সুব্রত মল্লিক। বললেন, ‘‘যাঁরা জানতে চাইছেন, তাঁদের বলছি, আতঙ্কের কারণ নেই। পঞ্চায়েতগুলিকেও বলছি মানুষকে বোঝাতে।’’

বাদুড়িয়ার গ্রামে সাইকেল সারানোর দোকান বিশ্বম্ভর সরকারের। তাঁর বাবা রাস্তার ধারে ঝুপড়িতে থাকতেন। দাদু অন্যের জমিতে কাজ করার সুবাদে মনিবের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে এক টুকরো জমি কিনে বাড়ি করেছেন বিশ্বম্ভর। আধার আর ভোটের কার্ডই দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁর একমাত্র নথি। কিন্তু ’৯৫ সালের নথি দিয়ে কি লাভ হবে কিছু? রেশন কার্ডে নাম সংশোধন করতে আসা বিশ্বম্ভরের প্রশ্ন শুনে পাশের ভিড়টা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

রেশন কার্ড, আধার কার্ড থাকা সত্ত্বেও চল্লিশ বছর এ দেশে কাটিয়ে দেওয়া বছর আশির সেলিম লস্কর ভয়ে কাঁটা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বকুলতলার এই বাসিন্দা জানালেন, কয়েক বছর ভোটার কার্ড পুড়ে যাওয়ায় আর করা হয়নি। বাড়ির মেয়ে-বৌরা হরবখত কাঁদছেন।

গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং-সহ বিভিন্ন এলাকার প্রচুর মানুষ ১৯৭১ সালের আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছিলেন। এ দেশের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড— সবই আছে। তবু আছে ভয়। বাসন্তীর মসজিদবাটীর সাজিদ মোল্লা, সাদ্দাম শেখ, আলেয়া বেওয়া আতঙ্কিত সকলেই। ১৯৭০-৭১ নাগাদ বাংলাদেশ থেকে এসে মসজিদবাটী এলাকায় বাসা বাঁধেন রানুবালা পাল। কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গিয়েছেন। সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা বলেন, ‘‘একবার ঘা খেয়ে ও দেশ থেকে এখানে এসেছি। আবার কি ভিটেহারা হতে হবে!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement