শুক্রবার বিকালে ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চের আইএমএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি আর ভি অশোকন (বাঁ দিক থেকে চতুর্থ জন)। —নিজস্ব চিত্র।
১৪০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ধর্মতলায় অনশন করছেন ছয় জুনিয়র ডাক্তার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে তাঁদের। অনিকেত মাহাতো ভর্তি হাসপাতালে। এমন অবস্থায় অনশনমঞ্চে এসে আইএমএম-এর সভাপতি বলেন, ‘‘জীবন সবার আগে, কঠিনতম পথে যাবেন না।’’ একই সঙ্গে অনশন তুলে নেওয়ার আর্জিও জানিয়েছেন তিনি।
জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার পর আইএমএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি বলেন, “অনশনকারীরা নিজেদের জন্য লড়ছেন না। তাঁরা লড়ছেন সাধারণ মানুষের জন্যই।”
বৃহস্পতিবার রাতেই অনশনমঞ্চ থেকে অনিকেত মাহাতোকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। আপাতত তিনি ভর্তি রয়েছেন আরজি করেই। শুক্রবার বিকেলে জুনিয়র ডাক্তার দেবাশিস হালদার জানিয়েছেন, অনিকেতের শারীরিক অবস্থা বর্তমানে অনেকটাই স্থিতিশীল এবং বেশ কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করানো হয়েছে। তিনি বলেন, “ অনিকেত হাসপাতালে ভর্তি হতে নারাজ ছিল। কিন্তু আমরা ওকে বুঝিয়ে ভর্তি করাই। সরকার অমানবিক হতে পারে। তবে আমাদের সহকর্মীদের শারীরিক অবস্থার বিষয়টা দেখতে হবে।’’ বাকি ছ’জন অনশনকারীরও শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন দেবাশিস।
জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চে পৌঁছে গিয়েছেন আইএমএ-র প্রতিনিধিরা। আইএমএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি আরভি অশোকন গিয়েছেন অনশনস্থলে। সেখানে তিনি কথা বলছেন অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে।
ডাক্তারদের ‘মহাসমাবেশ’কে আনুষ্ঠানিক ভাবে সমর্থন করল রাজ্য বামফ্রন্ট। রাজ্য বামফ্রন্টের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, সাধারণ মানুষকে শুক্রবার বিকালে ধর্মতলায় ডাক্তারদের ডাকা সমাবেশে অংশ নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে। সিপিএম সূত্রে খবর, দলের তরফে ‘নির্দেশ’ দেওয়া হয়েছে, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি এবং কলকাতা-সংলগ্ন দুই চব্বিশ পরগনা থেকে দলীয় কর্মীরা যেন শুক্রবার ধর্মতলার সমাবেশে যোগ দেন। এ-ও বলা হয়েছে, কোনও রকমের সাংগঠনিক পতাকা নিয়ে যেন কেউ না আসেন। নাগরিক হিসাবেই যেন কর্মসূচিতে অংশ নেন।
শুক্রবারই দিল্লি থেকে আইএমএ-র প্রেসিডেন্ট আরভি অশোকান আসছেন ধর্মতলায় আন্দোলনরত চিকিৎসকদের অনশনমঞ্চে। আরজি করে চিকিৎসাধীন আর এক অনশনকারী জুনিয়র চিকিৎসক অনিকেত মাহাতোর সঙ্গেও দেখা করবেন তিনি। এর পর আইএমএ-র তরফে একটি সাংবাদিক বৈঠকও করা হবে। আইএমএ বেঙ্গল-এর কার্যনির্বাহী দলের চেয়ারম্যান সৌরভ দত্ত বলেন, ‘‘আমাদের ভাই-বোনেরা এ ভাবে অনশনে বসে জীবন বাজি রেখে লড়ছেন। অথচ উল্টো দিকে সরকারের তরফে এখনও পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। আমরা শুধু চূড়ান্ত হতাশই নই, ক্ষিপ্তও। আজ বিকেলের মধ্যে যদি সরকারের তরফে কোনও সদর্থক ভূমিকা না নেওয়া হয়, তা হলে আমরা চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হব। আমরা গত কালও চিঠিতে এ কথা জানিয়েছিলাম। সরকার পদক্ষেপ না করলে আমরা আজই সাংবাদিক বৈঠকে সেই সিদ্ধান্ত জানাব।’’
আরও জোরালো আন্দোলনের বার্তা দিল ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট’। জুনিয়র ডাক্তারদের মিলিত মঞ্চের তরফে শুক্রবার সকালে সাংবাদিক বৈঠক করে দেবাশিস হালদার নাগরিক সমাজকে সংহতির বার্তা নিয়ে আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেন। শুক্রবার বিকেলে ধর্মতলার অনশনমঞ্চ সংলগ্ন অঞ্চলেই সমাবেশের ডাক দিয়েছেন তাঁরা। শহরবাসীর উদ্দেশে দেবাশিসের বার্তা, “আমাদের সহযোদ্ধাদের লড়াই ও মানসিক দৃঢ়তার পাশে দাঁড়ান। নবমীর বিকেলে ধর্মতলার মোড়ে এই জমায়েতকে এক ‘মহাসমাবেশ’-এর রূপ দিন।’’ ওই সমাবেশ যোগ দিতে আসা সাধারণ মানুষদের হাতে হাতে লিফলেট তুলে দেবেন তাঁরা। সেখানে উল্লেখ থাকবে জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিদাওয়ার কথা।
শুক্রবার সকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি পাঠাল জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জুনিয়র এবং সিনিয়র চিকিৎসকদের যাবতীয় দাবি মেটাতে সরকারকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানালেন তাঁরা। এর আগেও গত তিন দিন ধরে একই দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন, কিন্তু সুরাহা হয়নি।
এক সতীর্থ অসুস্থ। তবু মনোবল কমেনি বাকিদের। এখনও ধর্মতলায় অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন তনয়া পাঁজা, স্নিগ্ধা হাজরা, সায়ন্তনী ঘোষ হাজরা, অনুষ্টুপ মুখোপাধ্যায়, অর্ণব মুখোপাধ্যায় এবং পুলস্ত্য আচার্য। শনিবার থেকে টানা অনশনের জেরে তাঁরাও শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। উদ্বেগ বাড়ছে স্নিগ্ধাকে নিয়েও।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত মাহাতোর অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। অনিকেতের শরীরে জলশূন্যতা ছিল। তাঁর মূত্রে ‘কিটোন বডি’ও পাওয়া গিয়েছে। ইতিমধ্যেই অনিকেতের চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আরজি করের সিসিইউয়ের ইনচার্জ চিকিৎসক সোমা মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁরা অনিকেতের চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছেন। তাতে সোমা ছাড়াও রয়েছেন নেফ্রোলজি বিভাগের চিকিৎসক কানাইলাল কর্মকার, মেডিসিন বিভাগের সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ বিশ্বদীপ মজুমদার এবং চিকিৎসক সুজয় কুমার রায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্মতলার মঞ্চে গিয়ে অনিকেতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন আরজি করের চিকিৎসক সৈকত নিয়োগী। তিনি জানিয়ে দেন, অনিকেতের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন। আইসিইউ-তে পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি তাঁকে। এর পরে রাতে অনশনমঞ্চে যান রাজ্য সরকার গঠিত চার চিকিৎসকের একটি দল। অনশনকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তাঁরা জানান, অনিকেতের পাশাপাশি অনশনকারী আর এক জুনিয়র চিকিৎসক স্নিগ্ধা হাজরারও শারীরিক অবস্থা তুলনামূলক ভাবে বেশি খারাপ। অনিকেত এবং স্নিগ্ধা দু’জনকেই হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার বলে তাঁরা জানান।
চিকিৎসাধীন জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত মাহাতো। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতেই তাঁকে আরজি করের সিসিইউতে ভর্তি করানো হয়েছে। ধর্মতলার অনশনস্থল থেকে গভীর রাতে অনিকেতকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে আরজি করে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল সুত্রে খবর, অনিকেতের শরীরে আইভি ফ্লুইড চালানো হয়েছে। রক্তের একাধিক পরীক্ষাও করা হয়েছে। আরজি করের জুনিয়র ডাক্তার আশফাক উল্লাহ নায়ার বলেন, ‘‘সঠিক সময় নিয়ে আসার জন্য প্রাণঘাতী হয়নি। কিন্তু আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসা চলছে।’’
অনিকেত অসুস্থ, তবু দমেননি সতীর্থেরা। ধর্মতলায় এখনও অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। মহাষ্টমীর দিন সপ্তম দিনে পা রাখল তাঁদের অনশন।
আরজি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জুনিয়র ডাক্তার অনিকেত মাহাতোকে। — নিজস্ব চিত্র।