সবংয়ে ছাত্র খুনের ঘটনায় ছাত্র পরিষদ (সিপি) ও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-র মোট সাত জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। দশ মাসেরও বেশি সময় তাঁরা জেলবন্দি। ধৃতদের মধ্যে পাঁচ জন বুধবার কলকাতা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলেন। জামিনপ্রাপ্তদের মধ্যে তিন জন সিপি কর্মী। বাকি দু’জন টিএমসিপি কর্মী। ধৃত এক সিপি কর্মীর জামিনের আবেদন এ দিন নাকচ করে দেয় আদালত।
গত বছর ৭ অগস্ট সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ে সিপি কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানাকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে। ঘটনার পরেই টিএমসিপি কর্মী শেখ মুন্না, সানোয়ার আলি ও অসীম মাইতিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে একে একে সিপি কর্মী সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়, পল্টু ওঝা, সুদীপ পাত্র ও অনুপম আদককে ধরা হয়।
সবংয়ের ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দেন, ‘ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই এই ঘটনা ঘটেছে’। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সায় দেন পশ্চিম মেদিনীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষও। চার্জশিটেও ‘ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’-র তত্ত্বকেই কার্যত মান্যতা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। চার্জশিটে ১৯ জন সিপি কর্মী-সহ মোট ২১ জনের নাম রয়েছে। ধৃতদের মধ্যে অসীমের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। যদিও সে এখনও জেল হেফাজতেই রয়েছে। অসীমের মা সন্ধ্যা মাইতির বক্তব্য, ‘‘মামলা থেকে ছেলেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য দু’এক দিনের মধ্যেই নিম্ন আদালতে আবেদন করা হবে বলে আমাদের আইনজীবী জানিয়েছেন। ওঁকে সৌমেন মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। আমার আশা, ছেলেও বাড়িতে ফিরবে।”
এ দিন হাইকোর্টে বাকি ছ’জনের জামিনের আবেদনের শুনানি হয়। এ দিন সিপি কর্মীদের আইনজীবী উত্তম মজুমদার আদালতে সওয়াল করতে গিয়ে বলেন, ‘কৃষ্ণপ্রসাদ জানা খুনের ঘটনায় সবং থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন কলেজের ছাত্র পরিষদ পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়। পুলিশ উল্টে তাঁকেই গ্রেফতার করে। তা থেকেই বোঝা যায়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ভারতী ঘোষ শাসকদলের নির্দেশেই ছাত্র পরিষদের কর্মীদের এই মামলায় জড়িয়েছেন।’ উত্তমবাবু আরও জানান, ঘটনার পরে দশ মাস পেরিয়ে গিয়েছে। মামলার চার্জশিটও পেশ করেছে পুলিশ। তিন অভিযুক্তই ছাত্র। তাঁদের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই মামলায় অভিযুক্তদের জেলে বন্দি রেখে বিচার করার প্রয়োজনও নেই বলে উত্তমবাবু সওয়াল করেন।
একইভাবে, ধৃত টিএমসিপি কর্মীদের আইনজীবী দেবাশিস রায় ও সঞ্জীব দাঁ জামিনের আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘অভিযুক্তরা ছাত্র। তাঁরা লেখাপড়া করছেন। তা ছাড়া, অভিযুক্তদের কাছ থেকে নতুন কোনও তথ্যপ্রমাণও জোগাড় করতে পারেনি পুলিশ। সেই কারণেই তাঁদের জেলে আটকে রাখারও কোনও প্রয়োজন নেই।’
বিচারপতি দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে পল্টু বাদে বাকিদের জামিন মঞ্জুর করেন। আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, ঘটনার দিনের সিসিটিভি ফুটেজের একটি অংশে পল্টুকে দেখা গিয়েছে। চার্জশিটে মূল অভিযুক্ত হিসেবে এই সিপি কর্মীকে দেখানো হয়েছে। সেই কারণেই হয়তো তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ হয়ে গেল।
হাইকোর্টের নির্দেশ শুনে খুশি সুদীপের বাবা তাপস পাত্র। তিনি বলেন, ‘‘জেলা পুলিশ সুপার আমার ছেলেকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলবন্দি করে রেখেছিল। ওঁর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া হল। এই ন’মাসে আমরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। কিন্তু সত্যেরই জয় হয় তা আবার প্রমাণ হল।” সৌমেনের কাকা তপন গঙ্গোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘আমরা আদালতের ওপর ভরসা করেছিলাম। সত্যের জয় হয়েছে।’’
ভাই জামিন না পাওয়ায় মন খারাপ পল্টুর দাদা নির্মল ওঝার। তিনি বলেন, ‘‘ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজের একটি অংশে পল্টুকে দেখা গিয়েছিল। যদিও খুনের সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ প্রকাশ করতে পারেনি। পুলিশ আমার ভাইকে মূল অভিযুক্ত হিসেবে দেখিয়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আদালতে ওঁর জামিন মঞ্জুর না হওয়ায়
আমরা দিশাহারা।”
এ নিয়ে কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। দীর্ঘদিন বাদে এই পাঁচ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছে। পল্টুর জামিনের জন্যও আদালতে আবেদন করা হবে।” সবংয়ের তৃণমূল নেতা অমূল্য মাইতি বলেন, “সকলেই ছাত্র। মানস ভুঁইয়ার নীতিহীন রাজনীতির কারণে এই ছাত্রগুলির শিক্ষা জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আদালতের রায়ে তাঁরা জামিন পাওয়ায় আমরা খুশি।”