আপত্তি বিস্তর। তবু বাজেট বরাদ্দের টাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ভরানোর কাজে রাশ টানতে নারাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সরকারি কোষাগারের টাকা দান-খয়রাতিতে কেন খরচ করা হচ্ছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। কিন্তু তাদের পাঠানো সেই ‘নোট’ ফাইলবন্দি রেখে চলতি আর্থিক বছরে (২০১৪-’১৫) এ পর্যন্ত আরও ৪ কোটি ১০ লক্ষ টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করেছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর।
কেন স্বরাষ্ট্র দফতরই বারবার মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ভরাচ্ছে? দফতরের সচিব পর্যায়ের সব অফিসারই এই প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এক জন শুধু বলেছেন, “এই দফতর মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হাতেই রয়েছে। আমরা নবান্নের উঁচুতলার নির্দেশ পালন করছি মাত্র।” তবে সব ক্ষেত্রেই টাকা ছাড়ার আগে অর্থ দফতরের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের দাবি।
কিন্তু সরকারি কোষাগার থেকে টাকা তুলে এ ভাবে ত্রাণ তহবিলে জমা করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নবান্নে। সরকারি সূত্র বলছে, গত বছরের মার্চ মাসে প্রথম বার নিজেদের বাজেটের টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করে স্বরাষ্ট্র দফতর। নবান্নের এক কর্তা জানান, সেই মাসের ২ তারিখে কলকাতার টাউন হলে এক অনুষ্ঠানে মন্তেশ্বরের ১৬৬ জন ‘বঞ্চিত’ চাষির হাতে ৪৫ লক্ষ টাকা সাহায্য তুলে দেওয়ার সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “ত্রাণ দিতে গিয়ে তহবিলের প্রায় সব টাকাই শেষ হয়ে গেল...।” ওই বক্তব্যের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে, ৫ মার্চ স্বরাষ্ট্র দফতর তাদের পরিকল্পনা বহির্ভূত খাত থেকে ১ কোটি টাকা তুলে জমা দিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে।
সেই শুরু। তার পরে গত দু’বছরে একাধিক বার ওই ত্রাণ তহবিল ভরিয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতর। সিএজি যে তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয়েছে নবান্নে, তাতে ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে দু’দফায় ২ কোটি টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছে তারা। সেখানে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র দফতরের বাজেটের টাকা ত্রাণ তহবিলে জমা করার জন্য একটা নতুন অ্যাকাউন্ট (০৩-সিএল-২০১৩-কাউন্সিল অব মিনিস্টারস-০০-১০৫) খোলা হয়েছিল। এ পর্যন্ত যত বার টাকা জমা করা হয়েছে, তা ওই অ্যাকাউন্টেই পড়েছে।
এর আগে পর্যন্ত সাধারণ মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের দানেই চলত মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল। গরিব মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা বা খরা-বন্যায় আর্ত মানুষদের সাহায্যের জন্য টাকা বরাদ্দ করতেন মুখ্যমন্ত্রী। এই তহবিল থেকে টাকা বিলির বিষয়টি পুরোপুরি মুখ্যমন্ত্রীর বিবেচনাধীন। নতুন জমানায় নানা ভাতা ও পুরস্কার খাতে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করছে রাজ্য সরকার। যে কারণে প্রতি বছর লাফ দিয়ে বাড়ছে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয়। এর পরেও মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের কোটি কোটি টাকা কোথায় যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নবান্নের অন্দরেই। এই তহবিলের টাকা খরচের হিসেব মেলেনি। কিন্তু প্রশাসনের একটি শীর্ষ সূত্র বলছে, একদা সারদা গোষ্ঠীর হাতে থাকা একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেল চালাতেই খরচ হচ্ছে ত্রাণ তহবিলের অনেকটা টাকা। এই টাকায় মূলত ওই চ্যানেলের কর্মীদের বেতন দেওয়া হচ্ছে।
জনগণের করের টাকা ত্রাণ তহবিলে ঢুকিয়ে তাই দিয়ে কেন চ্যানেল চালানো হবে, সেই প্রশ্ন যেমন থাকছে। তেমনই বাজেট বরাদ্দের টাকা ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার মতো ‘বেআইনি’ কাজ সরকার কেন বারবার করে চলেছে, তারও ব্যাখ্যা মেলেনি। নবান্নে পাঠানো রিপোর্টের পার্ট-২ (এ) অনুচ্ছেদে সিএজি স্পষ্ট বলেছে, ২০১৩-এর মার্চে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সরকার যে ভাবে ১ কোটি টাকা জমা করেছে তা বেআইনি। এই বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করার পরেও তারা কোনও পদক্ষেপ করেনি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই বছরেরই জুলাই মাসে ফের ১ কোটি টাকা একই ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করেছিল স্বরাষ্ট্র দফতর। কিন্তু সেই অর্থে কারা সাহায্য পেয়েছেন, কী ভাবে তাঁদের বাছাই করা হয়েছিল, বাছাইয়ের মাপকাঠিই বা কী ছিল, সেই সংক্রান্ত বিস্তারিত নথি পাওয়া যায়নি বলে নবান্নকে জানিয়েছে সিএজি।
তার পরেও সরকারি কোষাগারের টাকা ত্রাণ তহবিলে জমা করার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। নবান্ন সূত্র বলছে, চলতি আর্থিক বছরেই ৪ কোটি ১০ লক্ষ টাকা তুলে ত্রাণ তহবিল ভরেছে স্বরাষ্ট্র দফতর। এর মধ্যে মে মাসে ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা, জুন মাসে ১ কোটি টাকা এবং সেপ্টেম্বর মাসে ২ কোটি টাকা জমা পড়েছে। প্রশাসনের একাংশের অনুমান, বছরের শেষে টাকার অঙ্কটা আরও বাড়বে।
আমজনতার করের টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করা যাবে না, এই যুক্তি অবশ্য মানতে নারাজ প্রশাসনেরই একটা অংশ। তাঁদের পাল্টা বক্তব্য, রাজ্যের অর্থ-বিধিতে এ নিয়ে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা নেই। মুখ্যমন্ত্রীই যে হেতু প্রশাসনের প্রধান, তাই তাঁর সরকারের এক তহবিল থেকে অন্য তহবিলে টাকা পাঠানোর মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। তবে একই সঙ্গে বিষয়টি যে প্রথা বহির্ভূত এবং এক কথায় নজিরবিহীন, সে কথাও কবুল করেছেন ওই অফিসারেরা।
ক্ষমতায় এসে নিজের আঁকা ছবি বিক্রির ১ কোটি টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করার ঘোষণা করেছিলেন মমতা। তার পরে বেশ কিছু সংগঠন টাকা জমা করলেও দান-খয়রাতি এত বেড়ে গিয়েছে যে তহবিলের অর্থ তলানিতে ঠেকেছে এবং সেই ঘাটতি পূরণ করতেই শেষ পর্যন্ত করের টাকায় হাত দিতে হচ্ছে বলে মত প্রশাসনের একাংশের। নবান্নের এক কর্তা বলেন, “সরকারি নিয়ম-কানুন আমরাও জানি। কিন্তু উপরমহলের নির্দেশ মেনে নেওয়া ছাড়া কী-ই বা করার আছে?”