সীমান্ত মুছে একুশের ছায়ায় বনগাঁ যেন আদ্যন্ত ভাষা-ভূমি

জায়গাটা কারও নয়। ‘নো-ম্যানস্ ল্যান্ড’, কোনও দেশের ঠিকানা নেই সেখানে। সেই এক চিলতে না-ভূমি এ দিন শুধুই একুশের। দু’দেশের আপামর মানুষের। কড়া চোখের নজরদারি নেই। একই সঙ্গে উড়ছে ভারত- বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। দু’দেশের ভাষাপ্রেমীরা গেয়ে চলেছেন, ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না, ওরা আসবে চুপি চুপি’, যেন কাঁটাতার ছিঁড়ে ফেলার নিভৃত আর্জি।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:৪২
Share:

বনগাঁয় সেজে উঠছে ভাষা শহিদ বেদি। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

জায়গাটা কারও নয়। ‘নো-ম্যানস্ ল্যান্ড’, কোনও দেশের ঠিকানা নেই সেখানে।

Advertisement

সেই এক চিলতে না-ভূমি এ দিন শুধুই একুশের। দু’দেশের আপামর মানুষের।

কড়া চোখের নজরদারি নেই। একই সঙ্গে উড়ছে ভারত- বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। দু’দেশের ভাষাপ্রেমীরা গেয়ে চলেছেন, ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না, ওরা আসবে চুপি চুপি’, যেন কাঁটাতার ছিঁড়ে ফেলার নিভৃত আর্জি।

Advertisement

একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আপন মনে কেঁদে চলেছেন কেউ। ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ফুল। বিএসএফ এবং বিজিবি জওয়ানদের সামনেই দু’দেশের মানুষ মেতে উঠছেন ভাষা-উৎসবে। চেনা-অচেনার কাঁটাতারের দূরত্বটাই মুছে গিয়েছে এ দিন। বাংলাদেশি যুবক জড়িয়ে ধরছেন হিন্দিভাষী বিএসএফ জওয়ানকে। বুকে ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন। লেখা, ‘লাখো শহিদের রক্তে গড়া আমাদের এই বাংলা ভাষা’। বুঝে-না বুঝেই জওয়ানেরও চোখে জল। তাঁদের অপলক দৃষ্টিতে শুধুই বিস্ময় আর শ্রদ্ধা।

বরকত, সালাম, রফিকদের স্মরণে তৈরি অস্থায়ী বেদী ফুলের ভারে নুয়ে পড়ছে। চলছে গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ সে গানের সঙ্গে জনস্রোত, মালা, ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ঠিক যেন ঢাকার জগন্নাথ হলের সেই বেদী হয়ে উঠেছে সীমান্তের ওই ফুল-ঢাকা মঞ্চ।

যুবকদের অনেকেরই মাথায় কালো ফেট্টি, একুশের স্মারক। গালে তেরঙা পতাকা বা সবুজ লালের আঁকা পতাকা দেখে ভুল হয়ে যায় কে কোন দেশি।

গানের পাশাপাশি চলছে পথনাটক, কবিতা। আলোচনা ও আবেগে দু’দেশের কয়েক হাজার মানুষের বাঁধনহারা ছেলেমানুষির কাছে হার মানে নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি। কিছুক্ষণের জন্য হলেও মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যেন দুই বাংলা। আন্তজার্তিক সীমারেখে মুছে জন্ম হয়েছে অন্য এক বাংলার। যার স্বপ্ন এখনও দেখেন দু’বাংলার বহু ঘর হারানো মানুষ। তাঁদের চোখে তখন জল।

দুই বাংলার মানুষের কাছে এই ছবিটা আজ খুবই পরিচিত। এই দিনটির জন্য বহু মানুষ বছরভর হাপিত্যেশ অপেক্ষায় থাকেন। ভিন্ দেশের বন্ধুতে ওই একটি দিনই তো কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখবার সুযোগ মেলে। এক দিকে, যেমন যশোহর খুলনা, বরিশাল, ঢাকা থেকে বেনাপোল সীমান্তে এ দিনে ছুটে আসেন অনেকে, তেমনই বনগাঁ ভরে ওঠে শহর কলকাতা-সহ আশপাশের বিভিন্ন মফস্সলের উপচে পড়া উৎসাহী বাংলা ভাষির ভিড়ে।

বছর পনেরো আগের কথা। সবে ইউনেস্কো একুশকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০০২ সালে তৈরি হয়েছিল একুশে উদ্যাপন কমিটি। প্রথম বছরের যে সাড়া মিলেছিল তা প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। সেই আবেগ বনগাঁর পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে আজও।

একুশে উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক পার্থসারথি দে জানান, রাষ্ট্রসঙ্ঘ ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণার তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, ভাষা উৎসব সীমান্তের গা ঘেঁষে করলে কেমন হয়। অনুষ্ঠানের আর এক উদ্যোক্তা বিভাস রায়চৌধুরি জানান, সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় পথ চলা। তবে ভাষা দিবসের দখলদারি নিয়ে বাম-তৃণমূল দড়ি টানাটানিও যে কম হয়নি তা স্থানীয় বাসিন্দারা জানেন। জানেন নিখাদ ভাষা প্রেমীরাও। উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতাও বলছে সে কথাই।

প্রথম দিকে, আক্ষরিক অর্থেই অন্তত কিছুক্ষণের জন্য দুই বাংলা এক হয়ে যাওয়ার সেই দিনগুলির উপরেও নেমে আসে কাঁটাতারের বাধ্যবাধকতা।

হালের শাসক দলের ঔদ্ধত্যে বাম আমলের দখলদারির ছায়া। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নেতৃত্বে শাসক দল এখন ভাষা উৎসবে ঢুকে পড়েছে। পার্থবাবুর কথায়, “এখন ভাষা উৎসব থেকে আবেগ হারিয়ে গিয়েছে। রয়েছে দখলদারি।”

বনগাঁ শহরের বিএস ক্যাম্প মোড়ে পুরসভার পক্ষ থেকে তৈরি করা হয়েছে ঢাকার আদলে ভাষা শহিদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ। সেখানেও প্রতি বছর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিতর্ক থাকলেও সীমান্তের ভাষা উৎসব এখন বিস্তারিত।

সম্বৎসরের চেনা বনগাঁ যেন একুশের ছায়ায় তার দেশ-কালের ঠিকানা ভুলে হয়ে ওঠে এক না-চেনা আদ্যন্ত ভাষা-ভূমি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement