বামনগাছির বাসিন্দা কলেজ ছাত্র সৌরভ চৌধুরীর হত্যার মূল অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকারের অপরাধ জগতে হাতেখড়ি হয়েছিল বামনগাছি এলাকার রেলবস্তিতে, চোলাই বিক্রি দিয়ে। তারপরে ছোটখাটো চুরিতে হাত পাকায় শ্যামল। অপরাধ জগতে উঠতি যুবকটি জড়িয়ে পড়ে একাধিক ঘটনায়। সমাজবিরোধী কালুর দলে নাম লিখিয়ে ধীরে ধীরে নিজের প্রভাব বাড়াতে শুরু করে সে। সৌরভকে রেললাইনের ধারেই কুপিয়ে, পাথর মেরে খুন করা হয় বলে তদন্তে জানতে পেরেছে পুলিশ। পরে দেহ ফেলে দেওয়া হয় রেললাইনের উপরে। বেশ কয়েকটি ট্রেন চলে যায় দেহের উপর দিয়ে। ঘটনাটিকে রেলে কাটা পড়ে চালানোর চেষ্টায় ছিল দুষ্কৃতীরা। ঠিক যেমন দিন কয়েক আগে বিড়া ও গুমা স্টেশনের মাঝামাঝি এলাকায় ২২ নম্বর রেলগেটের কাছে গৌতম নামে এক যুবককে খুন করে দেহ ট্রেনের তলায় ফেলার চেষ্টা করেছিল দুষ্কৃতী কৃষ্ণ। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ট্রেনের আলোতে সেই ঘটনা নজের পড়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা ধরে ফেলেন কৃষ্ণের এক সাগরেদকে।
রেলপাড় এলাকায় চোলাই মদের কারবার বা জুয়ার ঠেকে চালানোর মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ নতুন নয়। বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখার গুমা থেকে বামনগাছি পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার রেলপথের দু’ধার অপরাধীদের আঁতুরঘরই বলেই কুখ্যাত। গুমার এক স্কুল শিক্ষক জানালেন দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর মতে, রেলবস্তি এলাকায় চোলাই-জুয়ার ঠেকে দুষ্কৃতীদের আনাগোনা দেখতে দেখতে বড় হয় ছোট ছেলেমেয়েরা। বাইরের ভাল পরিবেশে এদের মেলামেশার সুযোগ খুবই কম। সে কারণে অপরাধ জগতে অনেকে ঢুকে পড়ে সহজেই। তা ছাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিক থেকেও পিছিয়ে এই সব এলাকার মানুষ। তার উপরে আছে দারিদ্র্য।
প্রায়ই এই এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়া দেহ দেখতে পাওয়া যায়। অনেকেরই অনুমান, খুন-জখমের পরে দেহ ফেলে রেখে ট্রেনে কাটা পড়ে চালানোর ব্যবস্থা করে দুষ্কৃতীরা। বহিরাগত দুষ্কৃতীদেরও যাতায়াত আছে। স্থানীয় অপরাধ জগতের কারবারিদের মদতেই তাদের আনাগোনা।
গুমা স্টেশন থেকে বেলতলার (এখানে বসেই মদ খাইয়ে খুন করা হয়েছিল গৌতমকে) দূরত্ব মেরে কেটে পাঁচশো মিটার। রেলপাড়ে বসবাসের অভিজ্ঞতা কেমন জানতে চাইলে বাসিন্দারা মুখ খুলতেই ভয় পান। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পরে এক মহিলা বলেন, “আপনারা তো নিজেদের প্রয়োজন ফুরালে চলে যাবেন, আমাদের তো এখানে থাকতে হবে।” নিজের নামটুকু বলতে চাননি ওই মহিলা, বলাইবাহুল্য।
গুমা থেকে বামনগাছি পর্যন্ত রেললাইনের দু’পাশে বস্তি এলাকা। যেখানে মদ-গাঁজার অসংখ্য ঠেক চলে বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, লাইনের পাশে রেলের একটি পরিত্যক্ত কেবিন আছে ২২ নম্বর গেটের কাছে। সন্ধের পর থেকে সমাজবিরোধীদের আসর বসে সেখানে। বাইরে থেকেও জুটে যায় অনেকে। অবিলম্বে এই কেবিনটি সংস্কার বা ভেঙে ফেলার দাবি আছে। বাসিন্দারা সভয়ে জানান, এখানে চোলাই বিক্রি, জুয়ার ঠেকের পাশাপাশি রয়েছে ‘ধুর সিন্ডিকেট’। দালাল ধরে টাকা-পয়সা দিয়ে বাংলাদেশে যাতায়াতের ব্যবস্থারই স্থানীয় নাম ধুর পাচার। সেই কাজে টাকার লেনদেন হয় এই সব এলাকায়। বেআইনি পথে বাংলাদেশিরা এখানে এসে নিরাপদে থাকারও জায়গা পেয়ে যায়। সময় সুযোগ বুঝে তাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিউ ব্যারাকপুর ও মধ্যমগ্রাম থেকে এখানে চোলাই নিয়ে আসা হয়। কার্গিল যুদ্ধের পর অশোকনগরে তৈরি হয়েছিল কুখ্যাত ‘কার্গিল বাহিনী’। খুন-জখম সহ নানা অপরাধে জড়িয়েছিল ওই বাহিনীর সদস্যদের নাম। দুষ্কৃতীদের আস্তানা ছিল রেলপাড়ের এই সব এলাকায়।
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি? পুলিশের ভূমিকাই বা কেমন? দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যে কেমন আছেন রেলকলোনির মহিলারা?
(চলবে)