এক কাপ চা হয়ে যাক! হালকা মেজাজে জ্যোতিপ্রিয়। —নিজস্ব চিত্র।
জেলার নেতা তিনি। কিন্তু এত দিন বড় নেতাদের জৌলুষে যেন চাপাই পড়েছিলেন। এখন অবশ্য দিন পাল্টেছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বনগাঁ উপনির্বাচনের আগে থেকেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ায় জ্যোতিপ্রিয়র ‘জ্যোতি’ চোখে পড়ছে রাজ্যবাসীর।
তিনি এখন মুখে বলছেন, “আমি তো শিখণ্ডী মাত্র। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন মানুষ।” বলছেন, “দল আমাকে অনেক দিয়েছে। এ বার আমার তা ফিরিয়ে দেওয়ার সময়।” আরও বলছেন, “অসম্ভব একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।”
যে চ্যালেঞ্জটা সসম্মানে উতরে দিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল সভাপতি, ‘বালুদা’ নামেই যাঁকে জেলা রাজনীতিতে এক ডাকে চেনে সকলে। তবে জেলার বাইরেও বালুদার পরিচিতি কম নয়, মমতার মন্ত্রিসভায় খাদ্য দফতর সামলান তিনি।
বস্তুত, এ বার জ্যোতিপ্রিয়র চোখ দিয়েই বনগাঁর ভোটটা দেখলেন দলনেত্রী, এমনটা বললে অত্যুক্তি হবে না। মমতা নিজে আসেননি প্রচারে। কিন্তু “দিনে ১০-১২ বার বালুদার সঙ্গে কথা হত দিদির” বলছেন ঘনিষ্ঠ জনেরা। ভোটের ফল প্রকাশের দিন জ্যোতিপ্রিয়র সঙ্গে যখন বেলার দিকে প্রথম কথা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, তখন তৃণমূলের লিড প্রায় দেড় লক্ষের কাছাকাছি। তারপর থেকে বার পনেরো ফোনাফুনি হয়েছে দু’জনের। বালুর কাছ থেকে ‘পাকা খবর’ পাওয়ার পরেই সোমবার পুরুলিয়ার দিকে রওনা দেন মুখ্যমন্ত্রী। দলের এক নেতা বললেন, “দিদি খুব খুশি। বালুদাকে বলে গিয়েছেন, ভোটের কাজ যাঁরা করলেন, তাঁদের সকলকে এক দিন নিজে মিষ্টি খাওয়াবেন।”
এ বার বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জের ভোট ‘দিদি’র কাছেও ছিল বেশ চাপের। একে তো সারদা কাণ্ডে একাধিক নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ জেলে। কেউ কেউ দল ছেড়ে যাচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নেও চারিদিকে সমালোচনার ঝড় বইছে। দলের এই কঠিন সময়ে বনগাঁ লোকসভা ছিনিয়ে এনে (এমনকী সামান্য হলেও ভোট বেড়েছে গত বারের থেকে) জ্যোতিপ্রিয় যে পাকাপাকি দিদির ‘গুডবুকে’ ঢুকে গেলেন, সে কথা মানছেন অনেকেই।
মমতার সঙ্গে জ্যোতিপ্রিয়র সখ্য অবশ্য দীর্ঘ দিনের। ১৯৮৪ সালে জ্যোতিপ্রিয় তখন সুরেন্দ্রনাথ ল’কলেজের ছাত্র। সে বছরেই যাদবপুর কেন্দ্র থেকে প্রথম বার লোকসভা ভোটে লড়াই করছেন মমতা। তাঁর হয়ে ভোটের প্রচারে বিস্তর ঘাম ঝরিয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। ১৯৯৮ সাল থেকে উত্তর ২৪ পরগনায় জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক ছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের পরে নির্মল ঘোষের জায়গায় তাঁকে সভাপতি করেন নেত্রী। রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ে জ্যোতিপ্রিয়র।
তবে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের খাসতালুক ব্যারাকপুর মহকুমা, বারাসত, বা রাজারহাট-নিউটাউনে জ্যোতিপ্রিয়র নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কম বরাবরই। কিন্তু বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের সঙ্গে তাঁর অম্লমধুর সম্পর্ক ইদানীং অনেকটাই সহজ হয়েছে বলে দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে। কাকলিদেবীকে স্বরূপনগরের দিকে প্রচারে পেয়েছে তৃণমূল। রাজারহাটের নেতা সব্যসাচী দত্ত এসেছেন গাইঘাটায়। ভাষণ না দিলেও তাঁর উপস্থিতি দলের আভ্যন্তরীণ সমীকরণের ক্ষেত্রে জরুরি ছিল বলে মনে করেন তৃণমূলের অনেকেই।
মুকুল রায়, তাঁর ছেলে শুভ্রাংশু, মুকুল-অনুগামী বলে পরিচিত বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত, পার্থ ভৌমিক, সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীদের উপস্থিতিতে ব্যারাকপুর মহকুমায় অবশ্য জ্যোতিপ্রিয়বাবুর প্রভাব দীর্ঘ দিন ধরেই কম। কিন্তু এ বার ভোটের আগে থেকে দলে মুকুলবাবুর অবস্থান নিয়ে বিস্তর জলঘোলার মাঝে ব্যারাকপুর মহকুমার দিকেও প্রভাব বেড়েছে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর। গোটা জেলায় দলের উপরে কার্যত তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বনগাঁয় ভোটের ফল, যে প্রতিষ্ঠায় শিলমোহরও দিয়েছে।
মুকুলবাবুকে এ বার ভোটে তেমন ভাবে পাওয়া যাবে না ধরে নিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘুঁটি সাজিয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে বালুই ছিল দলে তাঁর বড় ভরসার জায়গা। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দলনেত্রী জ্যোতিপ্রিয়বাবুর সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে দলের একটি বিশ্বস্ত সূত্র।
বস্তুত, মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতুবন্ধনের কাজটি সেই ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকে করে আসছেন জ্যোতিপ্রিয়। ক্রমে ক্রমে মমতা রেলমন্ত্রী হয়েছেন। পরে মুখ্যমন্ত্রী। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ কমেছে। কিন্তু দু’তরফে সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখতে জ্যোতিপ্রিয়বাবু যে অনুঘটকের কাজ করেছেন, সে কথা মানেন জেলার বহু নেতাই।
এ বার ভোটে বিস্তর পরিশ্রম করেছেন বালু। গাইঘাটার মণ্ডলপাড়ায় সন্তোষ সেনের বাড়িতে ভোটের দিন কুড়ি আগে থেকে পাকাপাকি থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। এই বাড়িটি তাঁর ‘পয়া’ এমনটাই মনে করেন জ্যোতিপ্রিয়। এর আগেও বিভিন্ন ভোটের সময়ে এখান থেকেই লড়াই করেছেন তিনি।
বালুর ঘনিষ্ঠরা জানালেন, ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে পড়তেন দাদা। ভোর থাকতেই চলে যেতেন বনগাঁয় দলের কেন্দ্রীয় অফিসে। শুরু হত ফোন। প্রচারে সারা দিনে কে আসবে, কোথায় থাকবে, কী খাবে, মিছিল হবে কোথায়— খুঁটিনাটি নানা কিছু দেখেশুনে দুপুরে পার্টি অফিসেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে জ্যোতিপ্রিয়। বাড়ি ঢুকতেন ঘড়ির কাঁটা রাত ১১টা গড়ালে।
উত্তর ২৪ পরগনায় দল সামলানো যে খুব সহজ নয়, তা জানে দলের সকলেই। এই জেলায় এত দিন ছিলেন ৫ জন মন্ত্রী (এখন বাদ গিয়েছেন মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর), আছেন ৫ জন সাংসদ। নানা মুনির নানা মত। ভোটের কাজের জন্য রতন ঘোষ, বিশ্বজিৎ দাস, ধ্যানেশনারায়ণ গুহ, গোপাল শেঠ, অরবিন্দ দাশগুপ্ত, রিঙ্কু দে দত্তকে নিয়ে বিশেষ কোর কমিটি তৈরি করেছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের নদিয়ার অংশে ভোট পরিচালনার জন্য গৌরীশঙ্কর দত্ত, বাণী রায়, নীলিমেশ রায়চৌধুরী, চঞ্চল দেবনাথদের অনেকটা দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছিলেন বালু।
তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, ভোটটা নিয়ে দলনেত্রী দাদার উপরে খুবই ভরসা করছিলেন। কী ভাবে ‘স্ট্র্যাটেজি’ ঠিক করছেন বালু, তা নিয়ে কখনও প্রশ্ন করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা এক অর্থে বালুকে আত্মবিশ্বাস যেমন জুগিয়েছে, তেমনই চাপটাও আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে এখন চাপমুক্ত বালু। হাসছেন। আর বলছেন, “কখনও যদি রাজনীতি থেকে বসে যাই তো যাব। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছেড়ে কখনও যাব না।”