এই বাড়িতেই বিশ্বকোষ তৈরির কাজ করেছিলেন রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ভবনটির এমন জরাজীর্ণ দশা। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
পঞ্চদশ শতকে কবি বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসার ভাসান’ কাব্যে গঙ্গার দু’পারের বর্ণনায় কবি লিখেছিলেন, ‘‘মূলাজোড়া গাড়ুলিয়া বাহিল সত্বর/ পশ্চিমে পাইকপাড়া বাহে ভদ্রেশ্বর/ চাঁপদানি ডাইনে বামেতে ইছাপুর/ বাহ বাহ বলি রাজা ডাকিছে প্রচুর।’’ এই ‘মূলাজোড়া’ই পরবর্তী সময়ে মূলাজোড়, যা বর্তমান শ্যামনগরের আদি জনপদ। জল, জঙ্গল, শ্বাপদ আর দস্যু সব মিলিয়ে পূর্বতন শ্যামনগরের পরিবেশটাই ছিল অন্য রকম। এক সময় শ্যামনগরের এক প্রান্তে মূলাজোড় ব্রহ্মময়ী কালীবাড়ি আর অন্য দিকে মাদরালে জয়চণ্ডীদেবীর মন্দির এক সময়ে জঙ্গলাকীর্ণ এই মন্দির ছিল ডাকাতদের ‘সাধনক্ষেত্র’। বর্গী হামলার সময়েও স্থানীয় রাজাদের কাছে নিরাপদ ছিল জলা-জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট জনপদটি।
কিন্তু মূলাজোড়ের প্রাচীনত্ব নিয়ে জনশ্রুতি যাই থাক, মূলাজোড় কালীবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাই গোপীমোহন ঠাকুরের নাম। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার বাসিন্দা গোপীমোহন ১৮০৯ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, তাঁর আট বছরের মেয়ে ব্রহ্মময়ীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বিয়ের দিন পাল্কি করে আহিরীটোলা গঙ্গার ঘাটে ব্রহ্মময়ীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্নান করে জল ভরে আনার জন্য জলে নেমে তলিয়ে যায় ব্রহ্মময়ী। তার দেহ ভেসে ওঠে মূলাজোড় ঘাটে। এরপরেই স্বপ্নাদিষ্ট হন গোপীমোহন। ব্রহ্মময়ীকেই স্বপ্নে দেখেন তিনি। মূলাজোড় ঘাটে তার দেহ ভেসে উঠেছে স্বপ্নে জানতে পারেন এবং কালীরূপী ব্রহ্মময়ী তাঁকে বলেন, ‘‘আমি তোমার মেয়ে। আমার দেহ যেখানে ভেসে উঠেছে সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা কর।’’ গোপীমোহন মূলাজোড়ে গিয়ে মেয়ের দেহ পান এবং কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে কষ্টিপাথরের একটি কালীমূর্তিও পান। গোপীমোহন মন্দিরের কাজ শেষ করার আগেই অবশ্য মারা গিয়েছিলেন। মন্দিরটি সম্পূর্ণ করেন তাঁর ছোট ছেলে প্রসন্নকুমার ঠাকুর। জনশ্রুতি, বামাক্ষ্যাপা এক সময়ে এই কালীমূর্তি পুজো করতেন। প্রসন্নকুমার প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজটিও সংস্কৃত চর্চায় শ্যামনগরকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। তার কিছুই সংরক্ষণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত যেমন সঠিক ভাবে সংরক্ষণ হয়নি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, রসসাহিত্যিক তথা চিকিত্সক রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়দের স্মৃতি। তাই ভ্রমণপিপাসুদের নিশ্চিত গন্তব্য হতে পারা শ্যামনগরের লোকমুখে পরিচিতি আটকে আছে এই মূলাজোড় কালীবাড়িকে ঘিরেই।
হাভেলিশহর পরগনার সীমান্তবর্তী জনপদ অধুনা শ্যামনগরে এক সময়ে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারি ছিল। কিন্তু বর্গী হামলার সময়ে বর্ধমানের রাজমাতা কৃষ্ণকুমারী দেবী কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে রামদেব নাগ নামে এক কর্মচারীর নামে শ্যামনগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইজারা নিয়ে বর্তমান কাউগাছির কাছে একটি গড় তৈরি করেন। সেখানে মন্দির তৈরি করে নিজেদের কুলদেবতা শ্যামকিশোরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজমাতা কৃষ্ণকুমারী ও রাজকুমার তিলকচাঁদ মহাতাব এই গড়ে থাকতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এই জায়গাটি পরিচিত হয় ‘শামুকগড়’ নামে। রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়ের উত্তরসূরী, শ্যামনগরের গবেষক সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় জানালেন, শামুক আকৃতির গড় ছিল বলেই শামুকগড় নামকরণ হয়েছিল। পরবর্তীতে সেখান থেকেই শামনগর বা শ্যামনগরের উত্পত্তি। আগে রেলস্টেশনেও শামনগর লেখা হত। এখনও ডাকঘরে শামনগর লেখা আছে। গড় হারিয়ে গিয়েছে, রাজাদের কীর্তির কোনও অস্তিত্বও আর নেই। শ্যামনগরের ব্যাপ্তি হয়েছে অনেক। ভাটপাড়া আর গাড়ুলিয়া দুই পুরসভারই অংশ রয়েছে শ্যামনগরের মধ্যে। জঙ্গলে ঢাকা ছোট ছোট গ্রামগুলি এখন ঘিঞ্জি জনপদ। ট্র্যাফিক জ্যাম, কলকারখানার চিমনির ধোঁওয়া, দূষণের ভারে ধুঁকতে থাকা শহর। যদিও ধুলোর পরতে আবছা হয়ে যাওয়া ইতিহাসের দলিলে শ্যামনগরের অনেক না জানা কথা রয়ে গিয়েছে। এক সময়ে মূলত ক্ষত্রিয়দের বাসস্থান ছিল শ্যামনগরের আশপাশের গ্রামগুলিতে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কবি ভারতচন্দ্রকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান গড়ে তোলার জন্য কবি এখানে টোল চালু করেন। এক সময়ে বর্ধমানের রাজার অধীনে থাকাকালীন তাঁর দেওয়ান রামদেব নাগ ভারতচন্দ্রকে শ্যামনগর থেকে বাদুতে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দেন। কিন্তু বাসিন্দারা রায়গুণাকরকে অনুরোধ করেন, দেওয়ানের চাপের কাছে মাথা নত না করতে। শেষ পর্যন্ত ভারতচন্দ্র থেকে যান। ওই দেওয়ানকে নিয়ে ‘নাগাস্তব’ কাব্যটি লেখেন ভারতচন্দ্র। কিন্তু ভারতচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত টোলের আর অস্তিত্ব নেই। কথিত আছে, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এখানে ব্যবসা সূত্রে এসেছিলেন।
আর এক জন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। যাঁর নামে এই অঞ্চলের সব থেকে পুরনো ঐতিহ্যশালী স্কুলটি আছে। কান্তিচন্দ্র নিজে জয়পুরের রাজার দেওয়ান ছিলেন। ১৪০টি বাঁধ নির্মাণ করেছেন। পণ্ডিত এবং বিচক্ষণ এই মানুষটির নামে জয়পুরে একটি রাস্তা আছে। তাঁর ছেলে ঈশানচন্দ্রও বাবার যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন। তবে শ্যামনগরের ইতিহাস আর সাক্ষ্য যতটুকু ধরা আছে, তা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া রয়েছে একমাত্র ভারতচন্দ্র পাঠাগারে।
(চলবে)