কেশবচন্দ্র সেনের বাড়ির একটি জীর্ণ অংশ।
নিভে যাওয়া চুল্লি, কুলি লাইনে অপুষ্টিতে ভোগা অসহায় মুখগুলোর পাশেই এগিয়ে চলেছে উৎসব মুখর শহর নৈহাটি। প্রাচীন গৌরব তার শিরা-উপশিরায়। কিন্তু সেই গৌরবকে সংরক্ষণের মতো উদ্যোগ, তৎপরতার দেখা মেলে কই!
পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেল, নবাবি আমলে হাবেলি শহর (অধুনা হালিশহর) পরগনার অন্তর্গত ‘নবহট্ট’ পরবর্তী সময়ে বারাসত মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়। তারও পরে ব্যারাকপুর মহকুমার সঙ্গে যুক্ত হয় প্রাচীন এই জনপদ। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন পুরসভা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে নৈহাটি। ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৮৬৯ সালের ১ মে নৈহাটির উন্নতিকল্পে ‘নৈহাটি টাউন কমিটি’ গঠিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবা যাদবচন্দ্র ছিলেন কমিটির প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান। ১৮৭৩ সালে বঙ্কিমচন্দ্র টাউন কমিটির চেয়ারম্যান হন। আর যাদবচন্দ্র হন ভাইস চেয়ারম্যান। ১৮৮৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নৈহাটি টাউন কমিটি পুরসভা হিসাবে ঘোষিত হয়। এক সময়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও নৈহাটি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার আগে নৈহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন বরদাকান্ত মিত্র। সাহিত্য সম্রাটের ভিটের রক্ষণাবেক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ ছিল তাঁরই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নৈহাটির প্রথম পুরপ্রধান হন বরদাকান্তের ছেলে বিনয়কৃষ্ণ। প্রথম দিকে পুরসভার সীমানা ছিল উত্তরে কাঁচরাপাড়া ও দক্ষিণে ভাটপাড়া পর্যন্ত। নৈহাটির পশ্চিমে হুগলি নদী। পূর্ব দিকে বঙ্কিম স্মৃতি বিজড়িত কাঁটালপাড়া।
বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালিকে ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি বলেছিলেন। তাঁর সেই সমালোচনার সম্যক কদর করেছেন নৈহাটিবাসী, এ কথা বললে খুব অত্যুক্তি হবে না। বঙ্কিমচন্দ্রের ভিটে ছাড়া যথাযথ সংরক্ষণ হয়নি কিছুই। চেয়ারম্যান হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্র বা তাঁর বাবার স্বাক্ষরটুকুও সংগ্রহে নেই বর্তমান পুরসভার। বাম আমলের শেষে যখন নাট্যকার রবিন ভট্টাচার্য এই পুরসভার চেয়ারম্যান, তখন সংস্কৃতি চর্চার স্বার্থে বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর স্মৃতি বিজড়িত পুরভবন ভেঙে তৈরি হয় ‘ঐকতান’। শ্যামল মিত্র বা সুরসাধক কানাইদাস বৈরাগীর নামে রাস্তা হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু নৈহাটিবাসীর চোখের সামনেই শ্যামল মিত্র, সমরেশ বসুর বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় ফেলে ভেঙে ফেলা হয়েছে সমরেশ জায়া গৌরীদেবীর তানপুরা। ফেলে দেওয়া হয়েছিল সমরেশ বসুর লেখার ডায়েরি, কলম থেকে বহু জিনিসপত্র। পুরনো জিনিস কেনাবেচার লোক সে সব নিয়ে যাচ্ছে দেখে স্থানীয় কিছু মানুষ চেষ্টা করেছিলেন সেগুলি উদ্ধারের। কিছু হয়েছিল, অনেকটাই হয়নি। পুর প্রশাসন সে দিনও আত্মবিস্মৃত হয়েই থেকেছে। নতুন পুরভবন লাগোয়া গ্যালারি হয়েছিল নৈহাটির মনীষীদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। সেটিও ফাঁকা। নৈহাটির চেয়ারম্যান তৃণমূলের রমেশ হালদার বলেন, “পুরভবন-সহ পুরনো দলিল পত্র প্রায় কিছুই সংরক্ষণ হয়নি। বাম আমলেই যা হারানোর হারিয়েছে।” যদিও প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী, নৈহাটির পুরনো বাসিন্দা রঞ্জিত কুণ্ডু অবশ্য দাবি করেছেন, “ইতিহাসের বহু দলিল পুরসভায় ছিল। নতুন পুরবোর্ড আসার পরে তা হস্তান্তরও করা হয়। সেগুলি অবশ্য এখন আর চোখেও দেখা যায় না।”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর হাতে গড়া, নৈহাটির সব থেকে পুরনো মহেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৬৮ সালে এই স্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জীর্ণ অবস্থা এই স্কুলের পুরনো ভবনের অধিগ্রহণের জন্য সরকারের কাছে ছুটোছুটি করে হাল ছেড়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এমন স্কুলের সংস্কার ও আধুনিকীকরণের থেকে পুরসভা, সরকারের জন প্রতিনিধিরা বেশি উদ্যোগী আধুনিক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতি, এমনই মনে করেন স্থানীয় মানুষ।
শুধু ইতিহাসকেই নয়, ইতিহাসের রক্ষককেও আমল দেয়নি এই শহর। নৈহাটির ইতিহাস আগলে রাখার কাজ যিনি বহু দিন ধরে করে চলেছেন, তিনি এক জন শ্রমিক, সুকুমার নাথ। বন্ধ গৌরীপুর জুটমিলের কুলি লাইনের ভাঙা ঘরে থাকেন। সামান্য টিউশনের আয়ে সংসার চলে বছর প্রবীণ মানুষটির। ভাবী প্রজন্মের কাছে নিজের মাটিকে চেনানোর তাগিদ থেকে এই শহরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার কাজ করছেন। সুকুমারবাবুর কথায়, “নতুন প্রজন্মের কাছে এই কাজ কতটা গুরুত্ব পাবে জানি না। তবে আমি এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই কাজটা করছি।” কিন্তু তাঁর এই কাজের তেমন স্বীকৃতি পাননি, তাই ক্ষোভ তো থাকবেই অল্পবিস্তর। তবে সুকুমারবাবুর কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্থানীয় কিছু মানুষ তাঁর সঙ্গে ‘নৈহাটি স্মারক গ্রন্থ’ তৈরির কাজ শুরু করেছেন। সেখানে প্রাচীন এ শহরের ইতিহাস-কথার পাশাপাশি আধুনিকীকরণের কথাও থাকছে।
পুরনো সরকারি হাসপাতালের উন্নতির কোনও চেষ্টা দেখা যায় না। এ দিকে, নাকি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। পুরনো হাসপাতালটির আধুনিকীকরণ না হওয়ায় অসুস্থ রোগীকে ব্যারাকপুর বা কলকাতায় রেফার করাটা প্রায় দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে উন্নয়নের ধারায় নৈহাটি যে জোর কদমে হাঁটছে, তা মনে করেন শহরবাসী। আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম, পার্ক, ঝাঁ চকচকে আধুনিক স্কুল, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হচ্ছে। বঙ্কিম পার্কের কাছে ৩৫ একর জমি কেনা হচ্ছে জল প্রকল্পের জন্য। সাজানো হচ্ছে নৈহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাবের ইনডোর স্টেডিয়ামটিকে। স্টেশনের কাছে হকার্স কর্নার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
(শেষ)
ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।