সওয়া ৩টে। বনগাঁ থানার কাছেই সুনসান রাস্তাঘাট।
নম্বরপ্লেটহীন মোটর বাইক আরোহী, মদ্যপ আর কুকুর উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্তবর্তী বনগাঁ শহরের রাত কার্যত এদেরই দখলে। হাতে গোনা কিছু আরজি পার্টির সদস্য আর বার কয়েক পুলিশি টহল ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ল না। বেশির ভাগ এটিএমে নিরাপত্তা রক্ষীর দেখা মেলেনি। কোনও ওষুধপত্রের দোকানও খোলা থাকে না রাতে।
বনগাঁ শহরের রাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে এখান মানুষ ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে এসে দুষ্কৃতীরা নানা অপরাধ ঘটিয়ে ফিরে যায়, এমন প্রমাণ অতীতে বহু মিলেছে।
রাত ১টা। বনগাঁ থানার পাশে ত্রিকোণ পার্ক এলাকা থেকে সঙ্গী ফটোগ্রাফার নির্মাল্য প্রামাণিককে নিয়ে দিলাম। হাইকোর্ট রোড ধরে যাওয়ার সময়ে চোখে পড়ল এক ভ্যান চালক মদ্যপ এক যুবককে ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন যশোহর রোড ধরে। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় সেতু পেরিয়ে পেট্রাপোল সীমান্তের দিক যাওয়ার সময় নেতাজি মার্কেট এলাকায় দেখা গেল, দোকানপাট সবই বন্ধ। সড়কের দখল নিয়েছে সারমেয়র দল। কিছুটা এগিয়ে রাখালদাস উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে গিয়ে দেখা গেল, অত রাতে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে মোবাইলে কথা বলছে এক যুবক।
রাত দেড়টা। যশোহর রোড ধরেই ১ নম্বর রেলগেট পেরিয়ে বক্সি পল্লি, সিকদার পল্লি এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, রাস্তাঘাট সুনসান। ফেরার পথে ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় কিছু ক্ষণ দাঁড়াতেই চোখ পড়ল নম্বরপ্লেটহীন মোটরবাইক নিয়ে সন্দেহজনক ভাবে পর পর দু’টি বাইকে ছ’জন যুবক গেট পেরিয়ে স্টেশন রোডে ঢুকে গেল। আমাদের দেখে হঠাৎই গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল তারা। বক্সি পল্লি, সুভাষ পল্লি, সিকদার পল্লি এলাকায় দুষ্কৃতীদের আনাগোনা দীর্ঘদিনের। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক জন খুনও হয়েছে এখানে। কিছু দিন আগেই খুন হন বিন্দু বক্সি নামে এক ব্যক্তি। যশোহর রোডের পাশে একটি চায়ের দোকানে গুলি করে খুন করা হয় তাঁকে। এখনও ওই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। এমনিতেই ওই সব এলাকার মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া রাতে বের হন না। পুলিশ না থাকায় তাঁরা নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন, এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। পুলিশের টহল চোখে পড়েনি ওই এলাকাতেও।
রাত পৌনে ২টো। ১ নম্বর রেলগেট ছেড়ে ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় আসার পথে ফের চোখে পড়ল লুঙ্গিপরা নম্বরপ্লেটহীন মোটরবাইক নিয়ে গোপালনগরের সুন্দরপুরের দিক থেকে কয়েক জন যুবক আসছে। কাছে আসতেই কড়া চোখে একবার মেপে নিয়ে দ্রুত ১ নম্বর রেলগেটের দিকে চলে গেল তারা। চড়কতলা, চম্পক সরণী, আমলাপাড়া, পশ্চিমপাড়া, গাঁধীপল্লি হয়ে যশোহর রোড পেরিয়ে রামনগর রোডে উঠলাম। ভিতর দিয়ে দত্তপাড়া, মাঝেরপাড়া, পূর্বপাড়া হয়ে পৌঁছনো গেল মিলনপল্লিতে, পুরসভার ট্রাক টারর্মিনাসের সামনে। চারদিক থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারাই।
রাত ২টো। বনগাঁ স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল, ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটি চায়ের দোকান তখনও খোলা। ফাঁকা ট্রেনের মধ্যে এক মদ্যপ অবস্থায় হল্লা করছিল নিজের খেয়ালেই। কেউ কিচ্ছুটি বলার নেই। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে এ দেশে বেড়াতে এসেছিলেন জনা সাতেক যুবক। শিয়ালদহ থেকে ফিরতে রাত হয়ে যাওয়ায় তাঁরা রাতটুকু প্ল্যাটফর্মেই শুয়ে ছিলেন। সাত সকালে পেট্রাপোল দিয়ে দেশে ফিরবেন। জানালেন, কলকাতার অনেকেই নাকি পই পই করে বলে দিয়েছেন, প্ল্যাটফর্মে না থাকাই ভাল। কিন্তু এক সঙ্গে অনেকে আছেন, এই ভরসায় থেকে গিয়েছেন। কলকাতা থেকে ফিরতে দেরি হওয়ায় গাঁড়াপোতার বাসিন্দা রমেন বিশ্বাস প্ল্যাটফর্মেই শুয়ে ছিলেন। বললেন, “বাড়ি ফেরার কোনও যানবাহনই নেই। স্টেশন চত্বরে গোটা দ’শেক ভ্যান ছিল বটে, কিন্তু সে সময়ে ভ্যানে চড়তে গেলে অনেক গুণ বেশি ভাড়া দিতে হয়। ভ্যান চালকেরা জানালেন, শহর এলাকার বাইরে তারা যান না। কারণ, ‘দিনকাল খারাপ’। এক ভ্যান চালকের কথায়, “দিনের বেলায় স্টেশন থেকে বাটারমোড় পর্যন্ত ভাড়া ৭ টাকা। রাতে ২০ টাকা নই। কী করব, প্যাসেঞ্জার তো বেশি মেলে না। রাত ১১টার পর থেকে আমরা বেশি ভাড়া নিয়ে থাকি।” প্ল্যাটফর্মে কোনও রেল পুলিশের টহল চোখে পড়ল না। রাতভর ঘুরে একমাত্র মতিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকা ছাড়া আরজি পার্টির টহলও সে ভাবে চোখে পড়ল না। এসডিপিও-র গাড়ি ত্রিকোণ পার্কে দেখা গিয়েছিল। যশোহর রোডেও এক বার যেতে দেখা গেল সেই গাড়ি। কিন্তু এই টহলদারি বাসিন্দাদের মনে কতটুকু ভরসা জোগায়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বঙ্গীয় স্বর্ণশিল্পি সমিতি ও বনগাঁ চেম্বার্স অফ কর্মাস সূত্রে জানা গিয়েছে, শহরে সোনার দোকান প্রায় দেড়শোটি। অন্য সব ধরনের দোকান রয়েছে হাজার দু’য়েক। মতো ওই দু’টি সংগঠনের সহ সম্পাদক দিলীপ মজুমদার রাতে শহরের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত। বললেন, ‘‘মাঝে মধ্যে পুলিশি টহল চোখে পড়লেও রাতে শহরের নিরাপত্তা বলে কিছুই থাকে না। সোনার দোকানে চুরি-ডাকাতি হয়েছে। অন্য দোকানেও রাতে চুরির ঘটনা ঘটে। কিন্তু দুষ্কৃতীরা গ্রেফতার হয় না। লোপাট যাওয়া মালপত্রও উদ্ধার হয় না। দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরলে রাতে ঘুম হয় না, ভাবি এই বুঝি দোকানের মাল চুরি হয়ে গেল। সকালে এসে আগে একবার দোকান দেখে তবে স্বস্তি পাই।” দিলীপবাবু জানালেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পণ্যবাহী যে সব ট্রাক সড়কে দাঁড়িয়ে থাকে, সেখান থেকেও মালপত্র চুরি হচ্ছে রাতে।
রাত আড়াইটে। শহরের ব্যস্ততম এলাকা বাটারমোড়ে একটি রেস্টুরেন্ট খোলা। বনগাঁ মহকুমা আদালত চত্বর, বাসস্ট্যান্ড, মহকুমাশাসকের দফতর, এসডিপিও অফিস, উপ-সংশোধনগার, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, সমষ্টি ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকের অফিস আছে এখানে। এক কথায় বনগাঁ শহরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এটি। অথচ এখানে না দেখা গেল পুলিশকর্মী, না দেখা গেল অন্য নিরাপত্তাকর্মীদের। অতীতে এখানেই দিনের বেলায় বাসের মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে। নির্মীয়মাণ বাড়ির ছাদে মহিলাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। রাতে বনগাঁ ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের লাইব্রেরিতে গুরুত্বপূর্ণ বইপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বনগাঁ ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সমীর দাস বলেন, ‘‘বিভিন্ন ঘটনার পরে পুলিশ কিছু দিন রাতে নিরাপত্তা দেয়। কয়েক দিন পরে ফের সে সব বন্ধ হয়। এখন যেমন পুলিশ এখানে টহল দেয় না। তবে আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। পুরসভার মাধ্যমে আদালতে পাঁচিল দেওয়ার অর্থ অনুমোদন হয়েছিল। তবে কী কারণে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, জানি না। রাতে বিপদ-আপদের আশঙ্কা তো থাকেই।”
রাত ৩টে। বনগাঁ-চাকদহ সড়ক ধরে চাঁপাবেড়িয়া পর্যন্ত গিয়ে দেখা গেল, বাইকে দুষ্কৃতীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোপালনগরের দিক থেকে তারা আসছে। বনগাঁ মহকুমা হাসপাতাল চত্বরে গিয়ে দেখা গেল, রোগীর আত্মীয়-পরিজনেরা ঘুমিয়ে রয়েছেন। তাঁরা জানালেন, রাতে নেশাখোরদের অনেককে দেখা গেলেও পুলিশের দেখা মেলেনি। সকলেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেল, কয়েক মাস আগেও হাসপাতালে পুলিশ ক্যাম্প ছিল। অনেক দিন হল তা তুলে নেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল থেকে পুলিশকে বলা হয়েছে, যাতে ওই ক্যাম্পটি ফের চালু করা যায়।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় দাবি করেছেন, “রাতে বনগাঁ শহরে পুলিশ টহল দেয় নিয়মিত ভাবেই। তবে বনগাঁ থানা এলাকাটি খুবই বড়। সব সময়ে হয় তো একই পয়েন্টে পুলিশ দেখা যেতে না-ও পারে। তবে সমস্যা থাকলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
(চলবে)
সমস্ত ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা।