নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় বসবে পুলিশ ও হল মালিক

ফাল্গুনী হলের কাঠের ফলস্ সিলিং খসে পড়ে রবিবার দুপুরে দুর্ঘটনা ঘটেছে বসিরহাটে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই এই কাণ্ড বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে পুলিশ। কিন্তু মহকুমার বাকি হলগুলির কী অবস্থা? স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, গত কয়েক বছরে বসিরহাট মহকুমার ৮টি সিনেমা হলের (ফাল্গুনী, মিলনী, দেবযাণী, বলাকা, রূপশ্রী, মিতালি, পল্লিশ্রী ও আশা) বাইরের চাকচিক্যে পরিবর্তন এসেছে। রংচঙে হল বাইরে থেকে দেখলে ঝাঁ চকচকেই মনে হবে। কিন্তু ভিতরের অবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দর্শকদের মনমতো নয়।

Advertisement

নির্মল বসু

বসিরহাট শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ০০:২৬
Share:

বসিরহাটের একটি হলে শো চলছে। দর্শক আসনের বেশির ভাগই ফাঁকা পড়ে।—নিজস্ব চিত্র।

ফাল্গুনী হলের কাঠের ফলস্ সিলিং খসে পড়ে রবিবার দুপুরে দুর্ঘটনা ঘটেছে বসিরহাটে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই এই কাণ্ড বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে পুলিশ। কিন্তু মহকুমার বাকি হলগুলির কী অবস্থা?

Advertisement

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, গত কয়েক বছরে বসিরহাট মহকুমার ৮টি সিনেমা হলের (ফাল্গুনী, মিলনী, দেবযাণী, বলাকা, রূপশ্রী, মিতালি, পল্লিশ্রী ও আশা) বাইরের চাকচিক্যে পরিবর্তন এসেছে। রংচঙে হল বাইরে থেকে দেখলে ঝাঁ চকচকেই মনে হবে। কিন্তু ভিতরের অবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দর্শকদের মনমতো নয়। কোথাও বসার সিট ভাল নয়। কোথাও অপরিষ্কার শৌচাগার দর্শকদের পক্ষে অস্বস্তিকর। কোথাও আবার ভিতরের দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ছবি ও শব্দের গুণগত মান গত কয়েক বছরে তুলনায় ভাল হলেও অন্য পরিকাঠামোর দিকে ততটা নজর নেই হল মালিকদের, এমনটাই অভিযোগ দর্শকদের। অন্য দিকে হল মালিকদের বক্তব্য, ব্যবসা বেশির ভাগ শো-তেই লোকসানে চলে। পরিকাঠামোর দিকে নজর দেওয়া যাবে কী করে?

কিন্তু পরিকাঠামোর কিছু গুণগত পরিবর্তন না করতে পারলে ফাল্গুনী হলের মতো ঘটনা আবারও ঘটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। রবিবার ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ ছবির প্রদর্শন চলাকালীন হলের ছাদ থেকে কাঠের চাঙড় খসে পড়তে শুরু করে। শো বন্ধ হয়ে যায়। হলের ভিতরে কার্যত ঘুটঘুটে অন্ধকার। আহত হন বেশ কয়েক জন। এক জনকে ভর্তি করতে হয় হাসপাতালে। বাকিরাও ছোটাছুটি, হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়েন। নিমেষে রটে যায়, সিনেমা হলের ছাদে বিমান ভেঙে পড়েছে। কেউ আবার মনে করে, ভূমিকম্প হচ্ছে। আতঙ্ক ছড়ায়। পুলিশ-দমকল আসে। সব মিলিয়ে হুলস্থূল পরিস্থিতি।

Advertisement

রবিবারের ঘটনার কথা মাথায় রেখেই বসিরহাটের পুলিশ কিছু পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফাল্গুনী হলটি আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বসিরহাট থানার আইসি সৌম্যশান্ত পাহাড়ি জানান, কয়েক দিনের মধ্যেই বসিরহাটের সব হল মালিককে ডাকা হয়েছে আলোচনার জন্য। সেখানে দমকল, পূর্ত দফতর এবং বিদ্যুৎ দফতরের প্রতিনিধিরাও হাজির থাকবেন। হলগুলিতে দর্শকদের নিরাপত্তা কী ভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন আইসি।

হল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে আরও কিছু বিষয় উঠে এল। ইদানীং প্রায় সব হলেই চালু হয়েছে বক্সে বসার ব্যবস্থা। দু’জন করে বসা যায় কাচ বা কাঠে ঘেরা বক্সে। কোথাও কোথাও বক্স শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। টিকিটের দাম সে ক্ষেত্রে অনেকটাই বেশি। সাধারণ টিকিট যদি ২৫-৭০ টাকার হয়, তা হলে বক্সের ক্ষেত্রে দু’জনের জন্য ১২০-১৪০ টাকা গুণতে হয়। গোটা হলে যেখানে মেরেকেটে বেশির ভাগ শো-তে জনা পঞ্চাশ দর্শক, সেখানে বক্সগুলি প্রায়শই ভরা থাকে। কিন্তু সেখানেও দর্শক সংখ্যাটা মেরেকেটেও হাতেগোনা আসন। এত কম দর্শক যেখানে, সেখানে বক্সের ভিতরে যদি কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে যায়, তা খেয়াল রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে হল মালিকদের অনেকেই জানালেন। বস্তুত, এমন ঘটনা বসিরহাটে ঘটেওছে। সিনেমা হলের বক্সের ভিতরেই এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে ধরা পড়ে এক যুবক। হল মালিকদের অনেকেরই বক্তব্য, হলগুলির বেশির ভাগ আকার-আয়তনে পেল্লায়। ৬০০-১০০০ আসন। সেখানে হাতে গোনা কয়েক জন দর্শককে নিয়ে শো চালাতে গিয়ে বাকি পরিকাঠামোর দিকে নজরদারি সত্যিই সম্ভব নয়। বিশেষ করে রাতের দিকে গুটিকয় দর্শক নিয়ে শো চালাতে ইতস্তত বোধ করেন হল কর্তৃপক্ষও।

বসিরহাটের সিনেমা হলের যা সমস্যা, তা মফস্সলের আরও অনেক হলেরই সমস্যা। ইন্টারনেট, সিডি প্লেয়ার, মোবাইল ফোন, পাইরেসির যুগে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার প্রবণতা কমেছে। বড় বাজেটের নতুন ছবিও হাউস ফুল হওয়া মফস্সলে ইদানীং খুবই কম। বসিরহাটের হলগুলির বেশির ভাগ লিজে নিয়ে চালান যাঁরা, তাঁরা থাকেন কলকাতা বা অন্যত্র। নিয়মিত নজরদারির অভাবের সেটাও একটা কারণ বলে মনে করেন স্থানীয় মানুষ।

আগে নানা রকম জলসার জন্য ভাড়া দেওয়া হত সিনেমা হলগুলি। কিন্তু ইদানীং জলসার সংখ্যা কমেছে। তা ছাড়া, বসিরহাটে টাউন হল, রবীন্দ্রভবন অনেক কম টাকায় ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠান করা যায়। ফলে উদ্যোক্তারাও সিনেমা হল ভাড়া করার ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে কিছু বড় ক্লাব ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল। সব মিলিয়ে হলের ব্যবসা কমছে দিন দিন। সেই সঙ্গে পরিকাঠামো এবং রক্ষণাবেক্ষণের দিকটিও অবহেলিত হচ্ছে।

কিন্তু মফস্সলের সিনেমা হলগুলি নিয়ে এলাকার মানুষের আবেগও প্রচুর। অনেকেই এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কৈশোর-যৌবনের দিনগুলিতে ফিরে গেলেন। মধু ঘোষ, সৌমেন্দ্রনাথ দাস, শ্যামল ভৌমিক, সুখময় দে-র মতো মানুষদের বয়স ষাট পেরিয়েছে। তাঁরা জানালেন, কিছু বছর আগেও বসিরহাটের মানুষ ততটা কলকাতামুখী হননি। এলাকায় শীতকাল পড়লেই জলসা লেগে থাকত। আর সারা বছর বিনোদনের জন্য ছিল সিনেমা হল। নতুন ছবি মুক্তি পেলেই হলের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার হিড়িক পড়ত। ৪৭ পয়সার টিকিট কেটে কত সিনেমা দেখেছি। আর এখন কত টাকা গুণতে হয়। যুবক বয়সে সিনেমার টিকিট কাটতে গিয়ে ছোটখাট গোলমালে জড়াননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দেবেন্দ্রনাথ সামন্তর কথায়, “হাতে দু’টো টিকিট নিয়ে যখন বেরোতাম ভিড় ঠেলে, মনে হত যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছি। কিন্তু হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সেই আবেগ এখন আর কোথায়!’’ পারমিতা হালদার, মহুয়া কুণ্ডু, স্বপ্না মজুমদাররা অবশ্য তরুণ প্রজন্মের। কিন্তু হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভ্যাস তাঁদেরও কম। ওই তরুণীরা জানালেন, “একে তো কেব্ল চ্যানেলের দৌলতে বাড়ি বসে বিনা খরচে ছবি দেখা যায়। তা ছাড়া, কম্পিউটার, মোবাইলেও অনেক কিছু চটজলদি হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। হলে গিয়ে অনেকটা সময় এবং টাকা খরচ করা হয়ে ওঠে না।” বয়স্ক মহিলাদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে আবার বোঝা গেল, টেলি সিরিয়ালের পর্দা থেকে মুখ সরিয়ে সিনেমা হলে যাওয়ার কোনও আগ্রহই বোধ করেন না তাঁরা।

এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে হল মালিকেরা ব্যবসা চালিয়ে মুনাফা করেও দশর্ক পরিষেবার কথা কতটা ভাববেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

কয়েক দিনের মধ্যেই বসিরহাটের সব হল মালিককে পুলিশের তরফে ডাকা হয়েছে আলোচনার জন্য। সেখানে দমকল, পূর্ত দফতর এবং বিদ্যুৎ দফতরের প্রতিনিধিরাও হাজির থাকবেন। হলগুলিতে দর্শকদের নিরাপত্তা কী ভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement