এ যেন টাকার খনি! ব্যারাকপুর থেকে বিটি রোড ধরে এগোতে এগোতে সেই খনি পৌঁছে গিয়েছে কলকাতার দোরগোড়ায় পানিহাটি, সোদপুর এমনকী দমদম পর্যন্ত।
বন্ধ কারখানার ইট-কাঠ বিক্রি করে লাখ-লাখ টাকা আদায় করে সিন্ডিকেট। আবার সেই জমিতে বহুতল নির্মাণে ইট-বালি-পাথর সরবরাহেও সিন্ডিকেটের দাপটে তটস্থ প্রোমোটারেরা। শুধু এখানেই শেষ নয়। পানিহাটি-সোদপুর এলাকায় সিন্ডিকেটের থাবা গেড়ে বসেছে গৃহস্থের নিত্যপ্রয়োজনীয় কেরোসিন-রান্নার গ্যাসেও!
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সিন্ডিকেটের দাপট অবশ্য এই নতুন নয়। নব্বইয়ের দশকের শেষে বাম আমল থেকেই গজিয়েছিল এই চারাগাছ। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে তা বাড়তে বাড়তে কার্যত মহীরুহের আকার নিয়েছে। আগে গোটা এলাকায় দু’তিনটি সিন্ডিকেট কাজ করত। এখন প্রতি পাড়াতেই দু’-তিনটি সিন্ডিকেট গজিয়ে উঠেছে। দাপট রাখতে প্রায়ই গোলমালে জড়িয়ে পড়ে তারা। খুন-জখমও বাদ পড়ে না।
সোমবার বিকেল সাড়ে চারটের সময়ে পানিহাটি স্বদেশি মোড়ে তৃণমূলের দলীয় অফিসে ঢুকে গুলি করে-কুপিয়ে খুন করা হয় বাপ্পা বল নামে এক যুবককে। এই খুনের নেপথ্যেও ওই এলাকার সিন্ডিকেট দ্বন্দ্বকেই দায়ী করছে পুলিশ। এলাকায় ঘুরেও একই কথা শোনা গিয়েছে বাসিন্দাদের মুখে। তাঁরা বলছেন, এলাকার সিন্ডিকেট-রাজে ক্রমাগত আধিপত্য কায়েম করতে থাকা তৃণমূলকর্মী বাপ্পাকে সরতে হয়েছে দলেরই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সিন্ডিকেটের হাতে।
ব্যারাকপুরে যেমন ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে রং বদলেছে অনেকে, তেমনই পানিহাটিতেও রং বদলেছে সিন্ডিকেটের চাঁইরা। যেমন, বাপ্পা। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকেই এলাকার এক দাপুটে সিপিএম নেতার সঙ্গে ঘুরতে দেখা যেত বাপ্পাকে। মাথার উপরে ‘হাত’ ছিল জেলার ক্ষমতাশালী নেতাদেরও। এলাকার পুরনো বাসিন্দারা বলছেন, বাপ্পা প্রথমে দলবল নিয়ে তোলাবাজি করত। পানিহাটির বিটি রোডের ধারে বন্ধ কটন মিলের জমিতে আবাসনের কাজ শুরু হতেই সিন্ডিকেটে ঢুকে পড়ে সে। এলাকার অন্যতম সিন্ডিকেটের চাঁই বোঁচার সঙ্গে রীতিমতো টক্কর দিতে থাকে। শুরু হয়ে যায় বাপ্পা-বোঁচার সিন্ডিকেটের লড়াই।
এই টক্কর চলার কিছু দিন পরেই গ্রেফতার হয় বোঁচা। লোকে বলে, বাম নেতাদের নির্দেশেই নাকি তাকে গারদে পুরেছিল পুলিশ। বছর তিনেক পরে বোঁচা জেল থেকে বেরিয়ে এলে গা-ঢাকা দেয় বাপ্পা। সেই থেকে বোঁচার নেতৃত্বেই সিন্ডিকেটের রমরমা ছিল। তা হলে বাপ্পা ফিরে এল কী করে?
পুলিশ সূত্রের খবর, রাজ্যে ক্ষমতা বদলের বছরখানেক আগে থেকেই তৃণমূল নেতাদের একাংশ বাপ্পাকে এলাকায় ঢুকিয়ে দেয়। পালাবদলের পর বোঁচাও চলে আসে তৃণমূলে। তবে শত্রুতা রয়েই গিয়েছে। একই দলের দু’টি গোষ্ঠী দু’টি সিন্ডিকেটকে মদত দেয়। তাদের ছত্রছায়ায় গজিয়ে উঠেছে আরও ছোট ছোট সিন্ডিকেট। একদা বাম ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতাদের কয়েক জন সেই সিন্ডিকেটগুলিকে মদত দেন। “আগে ওই নেতারা বামেদের ছাতার তলায় থেকে ইমারতি ব্যবসা করতেন। এখন নিজেরাই ছাতা খুলে বসেছেন।”মন্তব্য এক স্থানীয় যুবকের।
কী ভাবে ওই অঞ্চলে জাল বিছিয়েছে সিন্ডিকেট?
এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। পাঁচিল ভাঙা। অভিযোগ উঠেছে, সেই ফাঁক দিয়েই পাচার হয়ে যায় ভিতরের ইট-কাঠ। তার পরে কারখানার ফাঁকা জমিতেই বহুতলের কাজ শুরু হলে সেখানেও ইট-বালি-পাথর নিতে হয় সিন্ডিকেটের কাজ থেকে। বাম আমলের মতোই এই আমলে বিটি রোডের পাশে আর একটি বন্ধ কটন মিলে বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্পেও ইমারতিদ্রব্য সরবরাহ নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। বাপ্পাও সেই দ্বন্দ্বের অংশীদার বলেই পুলিশ সূত্রের দাবি।
ব্যারাকপুরে যেমন সিন্ডিকেট দিয়ে এলাকা দখলের ঘটনা রয়েছে, পানিহাটিতেও সিন্ডিকেট দিয়ে নেতাদের এলাকা দখলের অভিযোগ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশ সূত্রেও বলা হচ্ছে, সিন্ডিকেটের এলাকা দখলে রাজনৈতিক মদত রয়েছে। তাই এক-একটি দলীয় অফিস থেকেই এলাকার সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেটের চাঁইরা। কী ভাবে?
এই প্রসঙ্গেই উঠে এসেছে স্বদেশি ভবনের নাম। সোমবার বিকেলে ওই দলীয় অফিসেই খুন হয় বাপ্পা। পুলিশ সূত্রে বলা হচ্ছে, ওই দলীয় অফিসের কাছেই কটন মিলে বহুতল গড়ে উঠছে। ওই অফিসের ঠিক পিছনেই গ্যাসের গুদাম। নাকের ডগায় কেরোসিন তেলের দোকান। পুলিশের একাংশের দাবি, ওই গুদাম-দোকান থেকেই গ্যাস-কেরোসিনের কালোবাজারি চলে। কেএমডিএ-র প্রকল্পের ঠিকাদারেরাও সিন্ডিকেটের কাছ থেকে মাল কিনতে বাধ্য হন।
এবং এই লাখ-লাখ টাকার কারবারে জুড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের নামও। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, এলাকায় নিজের সিন্ডিকেটের দাপট কায়েম করতে পারলে আখেরে লাভ নেতাদেরই। কারণ, অনুগত সিন্ডিকেট টাকা আদায় করলে তার ভাগ পৌঁছবে নেতাদের ঘরেও। লোকে বলে, সিন্ডিকেটের দাপট বাড়তেই ফুলেফেঁপে উঠছেন নেতারা। শাসক দলের যে নেতারা বছর চারেক আগেও সাইকেল চেপে ঘুরতেন, এখন তাঁরা স্করপিও-ইনোভা ছাড়া নড়তে পারেন না।
বাপ্পা-খুনের ঘটনাতেও এমনই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা জেনেছে পুলিশ। তদন্তকারীদের একাংশ বলছেন, ওই এলাকায় বাপ্পার আধিপত্য থাকলে শাসক দলের কয়েক জন নেতার অসুবিধা হচ্ছিল। খুনে যে দলেরই গোষ্ঠী জড়িত, তা-ও জেনেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা বলছেন, বাপ্পাকে যখন স্বদেশি ভবনের ভিতরে কোপানো হচ্ছে, তখন দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক জন তৃণমূলকর্মী। খুন হওয়ার পরে তাঁরাও এলাকা ছেড়ে চলে যান।
শুধু রাজনীতিই নয়, প্রশ্ন রয়েছে শিল্পাঞ্চলের এই পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। একের পর এক খুন-জখম-তোলাবাজির ঘটনা ঘটলেও ব্যারাকপুর কমিশনারেট কার্যত নীরব দর্শক বলেই অভিযোগ বাসিন্দাদের। অনেকে বলছেন, “শুধু দুষ্কৃতীরা নয়, পুলিশকর্তারাও এখানে নেতা ধরেই টিকে থাকেন।”
(চলবে)