টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে কলা চাষ।
গঙ্গাসাগর: ভর দুপুরে সাদা রঙের গাড়ি গ্রামের ইট বাঁধানো পথে এগিয়ে যেতে বাড়ির সামনে ছোট জটলা তৈরি হয়ে গেল। বাড়ির উঠোনে ধান সেদ্ধ-শুকোনোর কাজ চলেছে। অচেনা লোক দেখে বাড়ির মহিলা কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন। এগিয়ে এলেন অমিত দাস। নিজের এক বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছেন অমিত ও তাঁর বাবা সুবোধ দাস। টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে এর আগে কখনও চাষ করেননি অমিতরা। এই প্রথম। ফলন দেখে যারপরনাই খুশি। অমিতের কথায়, “প্রধান সাহেব আর সদস্যের কথাতেই তো করলাম। এখন তো মনে হচ্ছে ভালই করেছি।”
রাজ্যের শেষ প্রান্তের গ্রাম পঞ্চায়েত দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর ব্লকের গঙ্গাসাগরের এই এলাকায় সারা বছর জমি পড়ে থাকে। বর্ষায় ধান ছাড়া আর তেমন কোনও ফসল হয় না, বৃষ্টির জলের উপরে নির্ভর করেই চলে চাষ। একশো দিনের কাজ প্রকল্প বদলে দিয়েছে সেই ছবি। টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে কলা চাষ করছেন গঙ্গাসাগরের বাসিন্দারা। মিলেছে সুফল। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান হরিপদ মণ্ডলের কথায়, “চাষিদের স্বনির্ভর করতে গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে আর্থিক ভাবেও চাষিদের সাহায্য করেছি। যাতে মানুষ উৎসাহিত হন। এর ফলে এলাকার অর্থনীতি বদলে যাবে।”
রাজ্যের একশো দিনের কাজের প্রকল্পের কমিশনার দিব্যেন্দু সরকার বলেন, “সাধারণত এই প্রকল্পে কলা চাষ করার সুযোগ নেই। কিন্তু টিস্যু কালচারের কলা চাষ করলে, তিন বছর পরপর ফল পাওয়া যায়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলির নির্দিষ্ট জীবিকার ব্যবস্থা করা যায়। তিন বছ পর তারা নিজেরাই চাষ করে নিয়মিত আয় করবে, এমনই আমরা আশা করছি। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠী থেকে চারা নেওয়া হয়। সব তরফেই আয় হচ্ছে। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়ার কোনও কোনও এলাকায় এ নিয়ে কাজ হচ্ছে।”
রাজ্যের কলা উৎপাদনের অনেকটাই হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। জেলায় দেশি পদ্ধতিতে যে কলা চাষ হয়, তাতে প্রতি কাঁদিতে ২০ কেজি মতো ফলন হয়। কিন্তু টিস্যু কালচারের মাধ্যমে তৈরি জি-৯ প্রজাতির কলায় উৎপাদন হয় কাঁদি প্রতি প্রায় ৩৫ কেজি। হলুদ রঙের বড় আকারের এই কলার কাঁদির উপর থেকে নীচ পর্যন্ত প্রতিটিই আকারে এক রকম। ফলে বাজারে ভাল দাম পাওয়া যায়। এখন বিভিন্ন শপিং মলেও এই কলা বিক্রি হয়। চাহিদাও বেশ ভাল। রাজ্যে কলা বিক্রি হয় কাঁদি-প্রতি দরে। ফলে চাষিরা তেমন দাম পান না। তা নিয়ে চাষিদের কিছুটা অনুযোগ রয়েছে। তাই কাঁদি দরে না বিক্রি করে কেজি দরে কলা বিক্রির পরিকল্পনাও করেছেন পঞ্চায়েতের কর্তারা। তবে এখনও তাতে সেভাবে সারা মেলেনি।
শুধু উৎপাদনই নয়, বাণিজ্যের দিকটিও ভেবে রেখেছে গ্রাম পঞ্চায়েত। স্থানীয় বাজারের কয়েক জন্য ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এই কলা রাজ্যের বড় শহরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে বিক্রির জন্য চাষিদের হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হচ্ছে না। জি-৯ প্রজাতির কলা উৎপাদনে একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে মহারাষ্ট্রের জলগাঁওয়ের। চাষিরা উৎসাহী হয়ে এই কলা চাষ করলে সেই একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারাও। প্রধান হরিপদ মণ্ডল জানিয়েছেন, কলা চাষের জন্য ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েতের তরফে গ্রাম সংসদের মাধ্যমে ১৯৯টি পরিবারকে বেছে নেওয়া হয়েছে। চাষের জন্য তাঁদের বিঘা প্রতি ৬৮ হাজার ৬২৮ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে পঞ্চায়েতের তরফে বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় এক কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা। চাষিরা জানিয়েছেন, কলা বিক্রি করে বছরে এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা আয় হবে। চাষের খরচ প্রায় ৭০ হাজার টাকার মতো। বাকি টাকা তাঁদের লাভ থাকবে বলেই জানিয়েছেন চাষিরা।
স্থানীয় বিধায়ক তথা সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান বঙ্কিম হাজরা বলেন, “গত তিন বছরে রাজ্য সরকার কৃষির অগ্রগতির জন্য নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে। কৃষির উৎপাদন, বাজার তৈরি, আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে উন্নয়নকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।”