পোর্ট ক্যানিংয়ের এটিই ছিল সদর কার্যালয়।
এক সময়ে পুরসভার কৌলিন্য পেয়েছিল ক্যানিং। পরাধীন ভারতে সুন্দরবনের এই এলাকায় বন্দরকে কেন্দ্র করে উন্নয়নও হয়েছিল বিস্তর। তৈরি হয় চালকল, নুনের গোলা। কিন্তু নানা কারণে পুরসভার তকমা হারায় ক্যানিং। সম্প্রতি কাকদ্বীপে এক সভায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, পুরসভা হবে ক্যানিং। ফের আশায় বুক বেঁধেছেন এখানকার মানুষ। কিন্তু প্রশাসনের কাছে পুরসভা তৈরি-সংক্রান্ত কোনও খবর নেই। ফলে কিছুটা বিভ্রান্তিতে ক্যানিংবাসী। যদিও তাঁদের আশা, পুরসভা তৈরি হলে এলাকার থমকে থাকা উন্নয়নে গতি আসবে।
কোন পরিপ্রেক্ষিতে ক্যানিংকে পুরসভা করা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসন কালে? তা বুঝতে হলে ফিরতে হবে ইতিহাসের পাতায়।
ভৌগোলিক কারণে বিদ্যাধরী নদীর একটি শাখা বাঁক নিয়ে মিশেছিল আঠারোবাঁকি ও করাতি নদীতে। তিনটি নদীর সংযোগস্থলে সৃষ্টি হয়েছিল প্রবল একটি ঘূর্ণি। যা পরে মাতলা নদীর জন্ম দেয়। এই নদীর পাড়েই তৈরি হয় ‘মাতলা গঞ্জ’।
বিভিন্ন পুরনো সরকারি নথিতে যা ‘মাতলা মৌজা’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা বন্দর নাব্যতা হারাতে শুরু করলে বিকল্প হিসাবে ব্রিটিশদের চোখ পড়ে মাতলা নদীর পাড়ে এই এলাকার দিকে। পুরনো তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, সে সময়ে নদীটি এতই খরস্রোতা ছিল, ভাটার সময়েও বড় বড় জাহাজ অনায়াসে নোঙর করতে পারত মাতলার পাড়ে, এই এলাকায়। লর্ড ডালহৌসির আমলে এখানে বন্দর তৈরির কাজ শুরু হয়। ডালহৌসির পরে গভর্নর হয়ে আসেন লর্ড ক্যানিং। তাঁর আমলে কলকাতার সঙ্গে রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত হয় এই এলাকা।
অন্য দিকে, নদীপথে হলদিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগের কাজ শুরু হয়। লর্ড ক্যানিংয়ের নাম অনুসারেই মাতলা গঞ্জ বা মাতলা মৌজার নামকরণ করা হয় ‘ক্যানিং টাউন’। ১৮৬২-৬৩ সালে চালু হয় ক্যানিং রেলপথ। প্রথম ধাপে রেল সংযোগ হয়েছিল সোনারপুর পর্যন্ত। পর্যায়ক্রমে তা চম্পাহাটি, ঘুটিয়ারিশরিফ এবং ক্যানিং পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। শোনা যায়, ১৯৩২ সালের ২৯ ডিসেম্বর স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের আমন্ত্রণে গোসাবায় তাঁর পল্লি উন্নয়ন দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রেলপথেই এসেছিলেন তিনি।
খাস মহলের অবস্থা এখন এমনই জরাজীর্ণ।
সরকারি সূত্রে জানা যাচ্ছে, দেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরশহর তকমা পেয়েছিল ক্যানিং। ১৮৬২ সালে ক্যানিংকে পৌরসভা করে উন্নয়নের তোড়জোড় শুরু হয়। ১৮৬৬ সালে ক্যানিংয়ের মাতলা নদীতে ২৬টি জাহাজ এক সঙ্গে ঢুকেছিল। তখনও অবশ্য এখানে কোনও ডক তৈরি হয়নি। ১৮৬৭-৬৮ সালে এক মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। দাঁড়ানো জাহাজে ঠোকাঠুকি লেগে প্রচুর ক্ষতি হয়। একটি জাহাজ ডুবেও গিয়েছিল। ‘অভিশপ্ত’ তকমা লেগে যায় ক্যানিং বন্দরের গায়ে। একে একে জাহাজ পাত্তারি গোটাতে শুরু করে। ১৮৭২ সালে শেষ দু’টি জাহাজও ক্যানিং ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকে আর কোনও জাহাজ কখনও ক্যানিংয়ে আসেনি। বন্দর হিসাবেও যবনিকাপাত হয় ক্যানিংয়ের। সেই সূত্রেই পুরসভা তৈরির কাজও থমকে যায়।
১৯৯৬ সালের ৬ মার্চ ক্যানিং ১, ২ ব্লক, বাসন্তী ও গোসাবাকে নিয়ে তৈরি হয় ক্যানিং মহকুমা। কিন্তু এখনও পুরসভা হিসাবে গড়ে না ওঠায় এলাকার মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রচুর। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ অভিযোগ আছে প্রায় সমস্ত পরিষেবা নিয়েই। ক্যানিং বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন-সংলগ্ন এলাকায় নিকাশি ব্যবস্থা বহু দিন ধরেই বেহাল। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জল দাঁড়িয়ে যায়।
বিশিষ্ট সমাজসেবী ক্ষিতীশ বিশাল, অনন্যা মুখোপাধ্যায়রা বলেন, “ব্রিটিশ আমলের পুরনো পৌর শহর ক্যানিং। অথচ, স্বাধীন দেশে তা এখনও পুরসভার স্বীকৃতি পেল না। পুরসভা হলে এলাকার অনেক উন্নয়ন হতে পারত।” সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যানিং পুরসভা হবে বলে ঘোষণা করেছেন। যদিও মহকুমা প্রশাসন সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে এখনও কোনও নির্দেশিকা এসে পৌঁছয়নি।
ক্যানিং ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের পরেশরাম দাস বলেন, “ক্যানিং পুরসভা হবে বলে তথ্য-পরিসংখ্যান চাওয়া হয়েছিল। আমরা সে সব জেলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখনও কোনও নির্দেশিকা পাইনি।” মহকুমাশাসক প্রদীপ আচার্য বলেন, “ক্যানিং পুরসভা তৈরির কাজ কোন পর্যায়ে আছে বলতে পারব না। এমন কোনও সরকারি নির্দেশ পাইনি।”
কেমন লাগছে আমার শহর?
আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-ক্যানিং’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১।
ফেসবুকেও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। www.facebook.com/anadabazar.abp