প্রগতি সঙ্ঘের মণ্ডপ সজ্জার কাজ চলছে জোর কদমে।
ইছামতীর দু’পাড় জমে উঠছে পুজোর সাজে। সীমান্ত শহর বনগাঁর পুজোর ঐতিহ্য বহু দিন আগেই গোটা রাজ্যে জায়গা করে নিয়েছে। শুধু মাত্র জেলা বা রাজ্যের মানুষই নয়, ও পার বাংলার মানুষও সমান আগ্রহে সামিল হন এখানকার উৎসবে। পুজোর দিন কয়েক আগে থেকেই ও পার বাংলার বহু মানুষ আত্মীয়ের বাড়িতে আসতে থাকেন। শুধু মাত্র রাত জেগে মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দেখার আকর্ষণে। পুলিশ প্রশাসনের হিসেবে পুজোর দিনগুলোতে শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়। উত্তর-দক্ষিণ কলকাতার পুজোর টক্কর যেন শুরু হয়ে যায় নদীর এ পার-ও পার জুড়েও। ওই সুস্থ জমাটি প্রতিযোগিতার ফলে আখেরে অবশ্য লাভ হয় সাধারণ দর্শনার্থীদের।
আধুনিকতা ও নানা বৈচিত্র্যের থিম পুজো নিয়ে এবারও ওই শহরের পুজো নজর কাড়তে চলেছে। অতীতে এখানে খুঁটি পুজোর চল সে ভাবে না থাকলেও কয়েক বছর ধরে তা ব্যাপক ভাবেই শুরু হয়েছে। বনগাঁর শারদ উৎসবের আরও একটি ঐতিহ্য রয়েছে। তা হল পুজোকে কেন্দ্র করে বহু শারদ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া। পুজো উদ্যোক্তারাও ভালো মানের সাহিত্য স্মরণিকা প্রকাশ করে থাকেন। বুধবার থেকেই দেখা গেল উৎসাহী মানুষ মণ্ডপ দেখতে বেড়িয়ে পড়েছেন।
দর্শক টানার প্রতিযোগিতায় যে পুজোগুলি প্রথম সারিতে থাকবে, তার মধ্যে অন্যতম মতিগঞ্জ ঐক্য সম্মেলনী ক্লাব। শহরের বহু পুরনো এই পুজোর এবারের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে মহাবলীপুরমের শিব মন্দিরের আদলে। তাতে দেখা যাবে বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। মূল গেটটি তৈরি হয়েছে দুবাইয়ের সব থেকে বড় হোটেলের আদলে। ক্লাব স্মরণিকায় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছা বার্তা থাকছে।
শান্তি সঙ্ঘের পুজো এবার ১৭ বছরে পা দেবে। বড় বাজেটের পুজো হচ্ছে। ৭০ ফুট উচ্চতার কাল্পনিক মন্দিরের আদলে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। উপকরণ হিসেবে রয়েছে স্টিলের চামস, ধূপদানি, স্টিলের পাত। এগিয়ে চলো সঙ্ঘের এবারের থিম ভূস্বর্গ কাশ্মীর। থাকছে ডাল লেক, টিউলিপ ফুলের বাগান, অমরনাথের মন্দিরও। সেনা ছাউনি তৈরির মধ্যে দিয়ে তাঁরা কারগিল যুদ্ধে শহিদদের স্মরণ করবেন। উৎসবের দিনগুলিতে থাকবে বাউল ও লোক সঙ্গীতের আসর। থাকছে আলোর তোরণ।
কুঠিবাড়ি স্পোর্টিং ক্লাবের মণ্ডপ হয়েছে পদ্মফুলের আদলে। থাকছে টেরাকোটার কাজ। জ্ঞান বিকাশিনী সঙ্ঘের মণ্ডপে অতিকায় রথের আদল। পাইকপাড়া সবুজ সঙ্ঘের ৫০ বছরের পুজোর থিম বিহারের কলিঙ্গরাজ মন্দির। থাকবে অজস্র জ্বলন্ত মাটির প্রদীপ।
নদীর অন্য পাড়ের পুজোগুলির মধ্যে এ বার নজর কাড়তে চলেছে অভিযান সঙ্ঘের পুজো। যশোহর রোডের পাশের এই ৬৯ বছরের পুজোর মণ্ডপ তৈরি হয়েছে থাইল্যান্ডের নাগেশ্বর মন্দিরের আদলে। মণ্ডপের ভিতরটি রাজস্থানের এক রাজবাড়ির অনুকরণে তৈরি।
রেটপাড়া স্পোর্টিংয়ের মণ্ডপে গ্রামবাংলার ছবি।
১২ পল্লি স্পোর্টিং ক্লাবের এ বারের থিম সমুদ্র। সামুদ্রিক মাছ, অক্টোপাস দিয়ে মণ্ডপ সজ্জা তৈরি করেছেন কাঁথির শিল্পীরা। প্রতিমা মেদিনীপুরের। জলকন্যার আদলে প্রতিমা। এ বারের তাঁদের ৩০ বছর।
১১ পল্লি যুব গোষ্ঠীর থিম মানসিক হাসপাতাল। থাকবেন ১৫ জন জীবন্ত মডেল। বনগ্রাম স্পোর্টিং ক্লাবের থিম ঢাকের আদলে শৈল্পিক মণ্ডপ। রামনগর রোড স্পোর্টিং ক্লাবের ৫৬ বছরের আলোক সজ্জায় দেখা যাবে দক্ষিণেশ্বর। মণ্ডপ কেদারনাথ মন্দরের আদলে তৈরি হয়েছে। পূর্বপাড়া প্রগতি সঙ্ঘের থিম কেরালার পাথনাপুরমের মন্দির। নারকেল গাছ দিয়ে রামায়ণ ও মহাভারতের নানা কাহিনি তাতে ফুটিয়েতোলা হয়েছে।
মুস্তাফিপাড়া যুব গোষ্ঠীর পুজো এ বারে ২৫ বছরে পড়ল। মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে রান্নার নানা উপকরণ, যেমন তেজপাতা, দারচিনি, শুকনো লঙ্কা দিয়ে। বৈজয়ন্ত ক্লাব তাদের ৮২ তম বছরের থিম করেছে প্রাচীন বটবৃক্ষ। সুভাষনগর সেবা সমিতির থিম তারাপীঠ। থাকছে তারাপীঠের মন্দির ও শ্মশান। ইয়ং বেঙ্গল স্পোর্টিং ক্লাব ইসকনের মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি করেছে। গাঁধীপল্লি বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব তাদের ৬৮ বছরে মণ্ডপ তৈরি করেছে কাল্পনিক রাজবাড়ির আদলে। চড়কতলা স্পোর্টিং ক্লাবের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে নেপালের বৌদ্ধ মন্দিরের আদলে। আমলাপাড়া অ্যাথলেটিক ক্লাবের ৬৫ তম বছরের থিম ডিজনিল্যান্ড। রবার বল দিয়ে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও থাকছে এলইডি আলোর সজ্জা।
প্রতাপগড় স্পোর্টিং ক্লাবের ৫৯ তম বছরে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে কর্ণাটকের মন্দিরের আদলে। আলোর থিম সামাজিক সচেতনতা। রেটপাড়া স্পোর্টিং ক্লাব তাদের ৬৮ তম বছরের থিম করেছে ধামসা মাদল। আলোতে থাকছে আইফেল টাওয়ার, বিশ্বকাপ ফুটবলের নানা মুহূর্ত। বলাকা সমিতির থিম ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’। মণ্ডপে থাকবে অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র। ডায়মন্ড ক্লাবের থিম বিচালি ও মাদুর কাঠি দিয়ে পটচিত্র। উজ্জ্বল সঙ্ঘ বাঁশের টুকরো দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করেছে। প্রফুল্লনগর সাংস্কৃতিক চক্রের তরফে এ বার মণ্ডপ তৈরি করা হচ্ছে কৃষ্ণমূর্তির আদলে।
গোপালনগর ফ্রেন্ডস কর্নার ক্লাবের থিম ছন্দা গায়েনের নিখোঁজ রহস্য। মণ্ডপ তৈরি হয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার আদলে। প্রতিমা কৃষ্ণনগরের। পাল্লার দক্ষিণপাড়া পুজো কমিটির এবারের থিম চা বাগানে দুর্গোৎসব। দেখা যাবে চা গাছের সঙ্গে জীবন্ত সব মডেল।
বৃষ্টি না হওয়ায় পুজোর বাজারও ভালো কাটছে ব্যবসায়ীদের। খুশি চাষিরাও। পুলিশ প্রশাসনের তরফে আয়োজন করা হয়েছে শারদ সম্মানের। পুলিশ জানিয়েছে, বনগাঁতে এ বারের পুজোর সংখ্যা প্রায় ৫০টি। সব মিলিয়ে আর মাত্র কয়েকটা দিন। ইতিমধ্যেই শহরের নানা প্রান্তে আলো জ্বেলে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। সেই রোশনাইয়ে বনগাঁয় পড়ে গিয়েছে সাজ-সাজ রব।
—নিজস্ব চিত্র।