সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের মৃত্যুতে বনগাঁ কেন্দ্রে উপনির্বাচন আসন্ন। মতুয়াবাড়ির ফাটল তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কেও ভাঙন ধরাবে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। বিজেপিও ঘাড়ের উপরে নিঃশ্বাস ফলছে। এই পরিস্থিতিতেও বাগদায় ঘর গুছিয়ে উঠতে পারল না তৃণমূল। মাঝে মধ্যেই নতুন নতুন ঘটনাকে সামনে রেখে দলের গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ্যে আসছে এখানে। পরিস্থিতি এমনই, একই দিনে দলের দু’টি অংশের পৃথক কর্মসূচি ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় কাউকেই অনুমতি দেয়নি পুলিশ-প্রশাসন। শাসক দলের নেতারা দলীয় কর্মসূচি পালন করতে চেয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে আবেদন করছেন, আর তা বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে— এমন ঘটনা যে বিরল, তা একবাক্যে মেনে নিচ্ছেন এলাকার মানুষ।
নতুন করে কী ঘটেছে?
বৃহস্পতিবার দলের একাংশ এলাকায় মিছিল করতে চেয়েছিল। সঙ্গে, দলীয় নেতার উপরে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে পুলিশের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়ার কথা ছিল। দলের অন্য একটি অংশ আবার একই দিনে মানব বন্ধন কর্মসূচি পালন করতে চেয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছিল। গোলমালের আশঙ্কায় প্রশাসন তরফে কোনও পক্ষকেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাতেও আবার রাজনৈতিক কূটকচালির অভিযোগ তুলে ক্ষোভে ফুঁসছে এক পক্ষ। তাদের বক্তব্য, দলেরই একাংশের কলকাঠি নাড়ার ফলে এমনটা ঘটেছে। বনগাঁর মহকুমাশাসক সুদীপ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই দু’টি কর্মসূচিরই অনুমতি দেওয়া হয়নি।”
পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ৩০ নভেম্বর বাগদা ব্লকের তৃণমূল সভাপতি দিলীপ ঘোষ থানায় লিখিত আবেদন করে জানান, ১১ ডিসেম্বর বাগদা ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে স্থানীয় হেলেঞ্চা এলাকায় একটি মিছিল করা হবে। গত ২০ নভেম্বর দলের নেতা তরুণ ঘোষের উপরে হামলার ঘটনায় এ দিন পুলিশকে স্মারকলিপিও দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। বেলা ১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কর্মসূচি চালানোর অনুমতি চাওয়া হয়েছিল।
পুলিশের কাছে ওই আবেদন জমা পড়ার পর দিন, গত ১ ডিসেম্বর তৃণমূলে বাগদা সেবাদলের চেয়ারম্যান চন্দন সরকার ওরফে বাপি থানায় লিখিত আবেদনে জানান, এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে তাঁরা ১১ ডিসেম্বর হেলেঞ্চায় মানব বন্ধন কর্মসূচি পালন করতে চান। বেলা ৩টে থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অনুমতি চাওয়া হয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বাগদা থানার পক্ষ থেকে দু’টি আবেদনই গাইঘাটার সিআই পার্থ সান্যালের মাধ্যমে বনগাঁর এসডিপিও মীর সাহিদুল আলির কাছে পাঠানো হয়। এসডিপিও তা মহকুমাশাসকের কাছে পাঠান। থানার পক্ষ থেকে বাগদার বিডিও মালবিকা খাটুরাকেও বিষয়টি জানানো হয়। পরে মহকুমাশাসক অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রশাসনের সিদ্ধান্তের কথা পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকে প্রচার করা হয়।
বুধবার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের পরে কোনও পক্ষই তাদের কর্মসূচি পালন করেনি। যদিও দলীয় কোন্দল চাপা রাখা যায়নি। দিলীপবাবু বলেন, “২৭ নভেম্বর আমরা এলাকায় মিছিল করতে চেয়ে পুলিশের কাছে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ও যুব তৃণমূলের পক্ষ থেকে ওই দিনই মিছিল করতে চেয়ে পুলিশের কাছে আবেদন করা হয়েছে। আমরা পিছিয়ে এসেছিলাম। এ বারও দেখলাম, আমরা আগে আবেদন জানানোর পরেও কে বা কারা তৃণমূলের নাম করে একই দিনে কর্মসূচি পালন করতে চেয়ে আবেদন করেছেন। আসলে কিছু লোক দলকে ব্যবহার করে বাগদাকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে।” গোটা ঘটনাটি জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকে জানানো হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। যদিও বাপিবাবু জানান, “ওই দিন যে আরও একটা কর্মসূচি ছিল, তা আমরা জানতাম না। বিষয়টি উপেনবাবু (স্থানীয় বিধায়ক উপেন বিশ্বাস) জানেন কিনা, তা-ও জানি না।”
বাগদায় এক সময়ে প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বরের সঙ্গে পঞ্চায়েত সমিতির তৎকালীন সভাপতি তরুণ ঘোষের বিরোধ ছিল বহু চর্চিত। কিন্তু গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে ফের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দেয়। এই কেন্দ্রে ভোটে জিতে মন্ত্রী হন উপেন বিশ্বাস। গত পঞ্চায়েত ভোটে দলীয় টিকিট বণ্টন নিয়ে দলীয় কোন্দল ব্যাপক আকার নিয়েছিল। বিবাদ মেটাতে জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়। সে সময়ে হেলেঞ্চা-সহ কয়েকটি পঞ্চায়েত এলাকায় টিকিট না পেয়ে বেশ কয়েক জন তৃণমূল নেতা-কর্মী নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পঞ্চায়েত সমিতির আসনেও কয়েক জন নির্দল প্রার্থী হয়েছিলেন। দলের পক্ষ থেকে সে কারণে কিছু নেতা-কর্মীকে বহিষ্কারও করা হয়। নির্দলের কেউ কেউ ভোটে জেতেন। বহিষ্কৃত কয়েক জনকে কিছু দিন আগে দলে ফেরানো হয়েছে।
গোষ্ঠীকোন্দলের ইতিহাস এখানে আরও দীর্ঘ। যদিও সে কথা মানতে চাননি উপেনবাবু। তিনি বলেন, “বাগদা তৃণমূলের মধ্যে কোনও কোন্দল নেই। বিরোধ মূলত পাচারকারীদের সঙ্গে যাঁরা পাচারকারী নন, তাঁদের। অসততাকে আমি প্রশ্রয় দিই না।” ১১ তারিখের বিষয়টি অবশ্য তিনি জানেন না বলেই মন্তব্য করেছেন।” তৃণমূল নেতাদের একাংশ মনে করেন, উপেনবাবু প্রশয় না দিলেও দলীয় কোন্দল এখানে বাড়ছে।”
বাগদার সাম্প্রতিক ঘটনায় বিরক্ত দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা নেতৃত্ব। জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি ও মুকুল রায়ের সঙ্গে কথা বলে প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠকে বাগদায় দলের স্থায়ী পর্যবেক্ষক করে দেওয়া হয়েছে। দলের মধ্যে মনোমালিন্য থাকতে পারে। তবে তা প্রকাশ্যে আসা উচিত নয়। শীঘ্রই সমস্যা মিটবে। সকলে মিলে বিজেপি-সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করব।”