চলছে ইফতার পার্টি। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
বছরের একটি দিনের জন্য তিনি ভুলে যান তাঁর রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পরিচয়।
পবিত্র রমজান মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে বাগদার প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দুলাল বরের বাড়িতে ইফতারের নিমন্ত্রণে আসেন হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে এখন আর নিমন্ত্রণের অপেক্ষা করেন না কেউই। এলাকার মানুষ নিজেরাই আগে থেকে জেনে নেন কবে হচ্ছে ‘পবিত্র ইফতার পার্টি’। যত্ন করে সকলকে পেট ভরে খাইয়ে তারপর ছাড়েন দুলালবাবু। শুধু মুসলিম সম্প্রদায় নয়, ভিড় করেন সব ধর্মের মানুষই। বস্তুত তাঁর বাড়ির ওই পার্টিই হয়ে ওঠে সব ধর্মের মিলনস্থল। শুক্রবারই হয়ে গেল সেই ইফতার পার্টি।
শুরুটা হয়েছিল একুশ বছর আগে। তিনি তখন বাগদা গ্রাম পঞ্চায়েতের কংগ্রেসের প্রধান। প্রথম বার ১৪ জনকে ইফতারে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন তিনি। তার পর থেকে নিমন্ত্রিতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে হাজির ছিলেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। যাঁরা ওই দিন আসতে পারেননি, পরের দিন তাঁদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে রোজা ভাঙিয়েছেন তিনি। প্রাক্তন বিধায়কের কথায়, ‘‘ছোট থেকেই মানুষকে খাওয়াতে ভালবাসি। ধর্মীয় হিংসা বন্ধ করে সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করতেই আমি প্রতি বছর এই পার্টি দিই।” দুলালবাবুর বৃদ্ধ বাবা দীলিপকুমার বর অবশ্য ছেলের এই কাজকে জনসেবা হিসাবেই দেখেন। তাঁর কথায়, ‘আমাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিমের কোনও ভেদ নেই। দুলাল তো জনসেবা করে মানুষকে খাইয়ে।”
ইতিমধ্যেই দলীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা দুলালবাবু। ২০০৬ সালে তিনি বাগদার বিধায়ক হন। ২০১১ সালে তাঁকে সরিয়ে উপেন বিশ্বাসকে বাগদা থেকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকে দলের মধ্যেই কমেছে দুলালবাবুর প্রভাব। তা বলে ‘ইফতার পার্টি’ দিতে তিনি কখনও ভুল করেন না। দলের নেতা কর্মীদের পাশাপাশি বাম কর্মীরাও তাঁর ডাকে হাজির হন। সকলেই ভুলে যান তাদের রাজনৈতিক পরিচয়।
স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার বছর পঞ্চাশের দুলালবাবুর। স্থানীয় কুরুলিয়া প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। কিছু চাষের জমিও রয়েছে। তা থেকে যা রোজগার হয়, তুলে রাখেন এই পার্টির জন্য। বাড়ির উঠোনে বড় প্যান্ডেল করা হয় এ দিন। আলোয় ঝলমল করে গোটা চত্বর। শুক্রবার বিকেলে তাঁর পার্টিতে এসেছিলেন কয়েকশো মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। সন্ধে ৬টা ২৮মিনিটে রোজা ভাঙা হয় কলা, খেজুর, শশা, আপেল ও ছোলা সিদ্ধ দিয়ে। তারপরে সেখানেই নমাজ পড়া হয়। শুরু হয় খাওয়া-দাওয়া। সবাই এক সঙ্গে বসে খান।
এ দিনের মেনুতে ছিল লুচি, ছোলার ডাল, আলু-কুমড়োর তরকারি। শেষ পাতে ছিল পায়েস। দুলালবাবু জানান, আগে সিমাই করা হত। কিন্তু ভাল রাঁধুনির অভাবে এখন আর তা হয় না। দুলালবাবুর পার্টিতে আমন্ত্রিত রবিউল মণ্ডল বলেন, ‘‘খাওয়াটা বড় কথা নয়। এখানে আসতে পারলেই মন ভাল হয়ে যায়। বছরভর এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকি আমরা।” হরিহরপুরের বাসিন্দা মোমিন মণ্ডল বলেন, “দুলালবাবু আমাদের এক সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন।”
একুশ বছর ধরে এই পার্টিতে আসছেন আনারুল দফাদার। বললেন, “এটা আমাদের কাছে বার্ষিক উৎসবের মতো। রমজান মাস পড়লেই আমরা কবে পার্টি হবে, তার খোঁজ নিতে শুরু করি। গোটা বাগদা থেকেই লোকজন আসেন এখানে।” দুলালবাবু নিজেও জানালেন, রমজান মাস পড়লেই পথে-ঘাটে লোকজন তাঁর কাছে জানতে চান, কবে হচ্ছে পার্টি। তাঁর কথায়, “এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?” পার্টির জন্য কিছু কার্ড ছাপানো হয়। সবার জন্য সে সবের বালাই নেই। আন্তরিকতাটুকুই যথেষ্ট!