অন্ধকার রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছেন দুই মহিলা। নিজস্ব চিত্র
বিদ্যাসাগর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইন্দিরা দাস সপ্তাহে তিন দিন কলেজ শেষ করে অন্যত্র পড়তে যান। সে সব দিনে বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে রাত ১০-৪০ নাগাদ ক্যানিং লোকাল ধরেন। ক্যানিং স্টেশনে যখন ট্রেন পৌঁছয়, তখন ঘড়িতে প্রায় ১১-৫০। বেশির ভাগ দিনই অটো বা টোটো পাওয়া যায় না বলে জানালেন ওই তরুণী। ফলে হেঁটেই প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ধলিরবাটি গ্রামের বাড়িতে ফেরেন। গোটা পথ সুনসান। ইন্দিরা বলেন, ‘‘ভয় তো লাগেই। চারদিকে যা সব ঘটছে, আরও বেশি ভয় লাগছে। গরমের সময়ে রাস্তাঘাটে তকবু কিছু লোকজন থাকে। শীতের রাতে তো রাস্তায় দু’টো কুকুরও চোখে পড়ে না। তবে মাঝে মধ্যে পুলিশের টহলদারি ভ্যান দেখি। ওতেই কিছুটা ভরসা পাই।’’ তবে সেই ভ্যান পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলে আবার ভয় চেপে বসে মনে।
বিমানসেবিকার প্রশিক্ষণ নিতে প্রতিদিন ভোর ৪টে ২২ মিনিটের ক্যানিং লোকাল ধরে কলকাতায় যান বছর একুশের মালবিকা রায়। ক্যানিংয়ের রায়বাঘিনি এলাকা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে এসে ট্রেন ধরতেন মালবিকা। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে বাড়ির লোকজনের কথায় সে রুটিন কিছুটা বদলেছে। বাবা সুশীল রায় নিজেই সাইকেলে করে মেয়েকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন। সুশীল বলেন, “আমরা মেয়ের বাবাদের ভয় তো বেশি। রাতবিরেতে একা একা মেয়েকে বাড়ির বাইরে ছাড়তে সাহস পাচ্ছি না।’’
ট্রেনের মধ্যেও মহিলা যাত্রীরা সুরক্ষিত নয় বলে অভিযোগ রয়েছে নিত্যযাত্রীদের। মহিলা কামরাতেও নিরাপত্তা কতটা, সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। মাস চারেক আগে ডাউন শিয়ালদহ-ক্যানিং মাতৃভূমি লোকালে মহিলা যাত্রীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন ট্রেনের মধ্যেই। এক যুবককে গ্রেফতার করেছিল রেল পুলিশ। নিত্যযাত্রী মহিলাদের দাবি, অনেক সময়েই মহিলা কামরায় কিছু যুবক উঠে পড়ে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মহিলাদের ওঠা নামায় বাধা সৃষ্টি করে। প্রতিবাদ করলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে। উড়ে আসে কটূক্তি। রাতের ডাউন ক্যানিং লোকালে তালদি ও ঘুটিয়ারিশরিফ স্টেশনের মধ্যেই এই ঘটনা বেশি ঘটে বলে অভিযোগ। সব ট্রেনে রেল পুলিশ না থাকায় অসভ্যতা দিন দিন বেড়েই চলেছে বলে জানালেন কোনও কোনও মহিলা নিত্যযাত্রী।
কলকাতার বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন সুমনা নস্কর। রাত ৯টার ট্রেনে ফেরেন ক্যানিংয়ে। বললেন, “বেশ কিছু দিন ধরে দেখছি ঘুটিয়ারিশরিফ স্টেশন থেকে কয়েক জন যুবক মহিলা কামরায় উঠে গেট আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তালদি বা বেতবেড়িয়া স্টেশনে মহিলারা ওঠানামা করতে গেলে বিভিন্ন ভাবে তাঁদের গায়ে হাত দেয়।’’ দিন কয়েক আগে এক জন প্রতিবাদ করায় তাঁকে গালিগালাজ করে। নোংরা অঙ্গভঙ্গি করে। রেল পুলিশকে জানানোর পরে দু’এক দিন বন্ধ ছিল, আবার পরিস্থিতি যে কে সেই। ভয়ে আর কেউ কিছু বলেন না বলেই জানালেন সুমনা অনেকেই। প্রতিটা ট্রেনে মহিলা কামরায় রেল পুলিশ দেওয়ার দাবি আছে সকলেরই।
ভোর বেলায় কাজের সূত্রে বেরোন অনেকে। প্রথম ক্যানিং-শিয়ালদহ লোকাল ছাড়ে ভোর ৩-৫০ মিনিটে। ওই ট্রেন ধরতে আরও বেশ খানিকটা আগে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় অনেককে। কিন্তু সে সময়ে রাস্তায় ভ্যান, রিকশা, অটো না মেলায় অনেকে সাইকেলে স্টেশনে আসেন। কেউ কেউ বা হেঁটেই পৌঁছন। রাতে ফাঁকা, নিঝুম রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে ভয় লাগে না?
এই প্রশ্নের উত্তরে ক্যানিংয়ের নিকারিঘাটা গ্রামের বাসিন্দা শুক্লা নস্কর বলেন, “ভয় লেগে কী হবে? পেটের তাগিদে গত আট বছর ধরে এ ভাবেই যাতায়াত করছি। তবে গ্রামের অন্য মহিলারা এক সঙ্গে মিলে স্টেশনে আসি। তাই কিছুটা নিরাপদ লাগে।’’ শুক্লার সহযাত্রী নমিতা সাঁফুই অবশ্য বলেন, “মাঝে মধ্যে যখন দলছুট হয়ে পড়ি, একা একা বাড়ি থেকে স্টেশনে যেতে হয়— তখন ভয়টা বেশ চেপে বসে।’’
রাতে দু’টি ভ্যান টহল দেয় বলে জানিয়েছে ক্যানিং থানার পুলিশ। কিন্তু সেই তথ্য কতটা ভরসা জোগাচ্ছে মহিলাদের মনে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।