ধৃতদের নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। নিজস্ব চিত্র।
মায়ের লোভ রেহাই দেয়নি নিজের নাবালিকা মেয়েকেও। বিক্রি করে দিয়েছিল যৌনপল্লিতে। নাতনির এ হেন লাঞ্ছনা মেনে নেননি দিদিমা। নিজের মেয়ের এমন কাজের জন্য পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি। তারই ভিত্তিতে গ্রেফতার হয়েছে ওই নাবালিকার মা-সহ দু’জন।
ঘটনাটা সামনে আসে বুধবার রাতে। যখন ক্যানিং থানায় বসে মাথা নিচু করে নিজের জীবনের নানা কথা বলে চলেছিল বছর চোদ্দোর মেয়েটি। পুলিশকে সে বলেছিল, ‘‘কাকু, আমি আর মায়ের কাছে ফিরে যাব না। মা আমাকে বিক্রি করে দিয়েছিল।’’
স্তম্ভিত ক্যানিঙের ওসি আশিস দাস। মেয়ের মা-ও ছিল সেখানে। মাকে দেখিয়ে মেয়েটি বলে, ‘‘তুমি তো আমাকে দিল্লিতে বিক্রি করে দিয়েছিলে। এখন চুপ করে থেকো না।’’ মায়ের মুখ থেকে তখন কথা সরছে না। হঠাৎই মেয়ের পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘‘আমি ভুল করেছি। ক্ষমা করে দে। আর কোনও দিন করব না।’’
পরে খবর দেওয়া হয় নাবালিকার দিদিমার কলকাতার ঢাকুরিয়ার তেলিপাড়ার বাড়িতে। তিনি এসে চুপ করে শোনেন সবটা। থেকে থেকেই মাথা নেড়ে বলছিলেন, ‘‘ছি ছি, এমন করল আমার মেয়েটা?’’ পরে বলেন, ‘‘ওকে নিজের পেটে ধরেছি বলতেও লজ্জা হচ্ছে। নিজের মেয়েটাকেও বিক্রি করে দিল!’’
কী ভাবে জানাজানি হল গোটা ঘটনা? বুধবার সন্ধ্যায় ক্যানিঙের নারায়ণগড় এলাকার স্থানীয় মানুষজন পুলিশকে জানান, মাঝবয়সী এক ব্যক্তি কিছু দিন ধরেই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছে। বছর চোদ্দোর একটি মেয়ে থাকে সঙ্গে। মাঝবয়সী অন্য এক মহিলা সেখানে মাঝে মধ্যে যাতায়াত করে। সকলেরই আচরণ সন্দেহজনক।
পুলিশ গিয়ে তিনজনকে থানায় নিয়ে আসে। সেখানেই মেয়েটি সব খুলে বলে। জানায়, বছর তিনেক আগে বাবা মারা গিয়েছে। সংসারে অভাব ছিল। মার্চ মাসে তাকে দিল্লির এক যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেয় মা। এ জন্য মাসে মাসে ১০ হাজার টাকা করে পেত মা। মেয়েটির বাবা মারা যাওয়ার পরে কিছু দিন তারা দুই বোন থাকত ঢাকুরিয়ায় দিদিমার কাছেই।
মেয়েটির দিদিমা বলেন, ‘‘আমার মেয়ের এক ননদ যৌনপল্লিতে থাকত। জামাই মারা যাওয়ার পরে মেয়ে নিজেও কিছু দিন দিল্লিতে যৌনপল্লিতে ছিল। সেটা আমরা জানতাম। কিন্তু নাতনিরা আমার কাছেই থাকত। ওদের কাছছাড়া করতে চাইনি। পরে মেয়ে নাতনিদের নিয়ে যায়।’’ বৃদ্ধা জানান, বড় নাতনি যাতায়াত একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রশ্ন করলে মেয়ে জবাব দিত, ওকে কাজে দিয়েছি। বৃদ্ধার আফসোস, ‘‘ভাবতেই পারছি না, নিজের মেয়েকে ও বিক্রি করে দিয়েছিল।’’
কিন্তু সেখান থেকে ক্যানিঙে কী ভাবে এল নাবালিকা? পুলিশ জানতে পেরেছে, দিল্লি থেকে ফিরে নরেন্দ্রপুরে দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতে শুরু করে ওই মহিলা। সেখানে একটি মেসে রান্নার কাজ নেয়। কিছু দিন দিল্লিতে থাকার সুবাদে যৌনপল্লির আঁটঘাট তার জানা হয়ে গিয়েছিল। সেখানেই মেয়েকে বিক্রি করে দেয় ওই মহিলা।
সেখানে নাবালিকার পরিচয় হয় বাসন্তীর এক ব্যক্তির সঙ্গে। মেয়েটিকে মনে ধরে তার। সে মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে আসে। ভুল ট্রেনে চেপে পৌঁছয় আসানসোলে। সেখানে রেল পুলিশ তাদের ধরে। পরে রেল পুলিশ ওই নাবালিকাকে তার মায়ের হাতে তুলে দেয়। মেয়েকে নিয়ে মা ফেরে নরেন্দ্রপুরে। এরমধ্যে ওই ব্যক্তি মেয়েটির সঙ্গে ফের যোগাযোগ করে। বিবাহিত হলেও বলে, মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে চায়। যদিও সে যে বিবাহিত সেটি মেয়ে কিংবা মেয়ের মা কেউ জানত না। ওই ব্যক্তিই মেয়েটিতে এনে নারায়ণগড়ে রাখে। সেখানে যাতায়াত করত নাবালিকার মা-ও। ওই ব্যক্তি বিবাহিত।
পাচারের অভিযোগে মেয়ের মাকে এবং নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়েছে।
এত সবের পরে কী বলছে মেয়েটির মা?
তার মুখে ঘুরে ফিরে একটা কথা, ‘‘ভুল হয়ে গিয়েছে।’’