ভাঙড়ে শক্তি বারাচ্ছে আইএসএফ। প্রতীকী চিত্র।
এক সময়ে তৃণমূল ছাড়া অন্য কেউ দাঁত ফোটাতে পারত না ভাঙড়ে। সেই আসন বিধানসভায় হাতছাড়া হয়। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে দলের ফাটল কী ভাবে সারিয়ে ভাল ফল করা যায়, তা এখন মাথাব্যথার কারণ শাসক দলের অন্দরে।
গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে আইএসএফের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে এই এলাকায়। তার উপরে ভাঙড় ১ ব্লকে শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তোলাবাজি, কাটমানি, স্বজনপোষণ-সহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে ভাঙড় ১ ব্লকের প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ দখল করেছিল তৃণমূল। সে সময়ে ব্লকের ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২০-২৫টি বুথে জয়লাভ করেছিল সিপিএম। কিন্তু বোর্ড গঠন করতে পারেনি। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভাঙড় ১ ব্লকের ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ২৭টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৩টি জেলা পরিষদের আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় তৃণমূল। বিরোধী দলগুলি সে সময়ে কোনও আসনেই প্রার্থী দিতে না পারলেও কেবলমাত্র চন্দনেশ্বর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের হোগলদাঁড়া বুথে তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। তৃণমূল জিতে যায়। জেলা পরিষদের ৪৭ নম্বর আসনেও সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। তৃণমূল জিতে যায়। কিন্তু সব কিছুর পরেও ভাঙড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে বিরোধীরা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙড় কেন্দ্রটি তৃণমূলের হাতছাড়া হয়ে যায়। জয়ী হয় আইএসএফ।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছে, জেলা, রাজ্য নেতৃত্ব ভাঙড় ১ ব্লকের যুযুধান সব নেতৃত্বকে এক জায়গায় আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ব্লকের প্রাণগঞ্জ, জাগুলগাছি, নারায়ণপুর-সহ অন্যান্য পঞ্চায়েত এলাকায় লিড পায় আইএসএফ। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলারমধ্যে একমাত্র ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রটি হাতছাড়া হয় তৃণমূলের। সেই থেকে ভাঙড়ে আইএসএফের বাড়বাড়ন্ত।
এক সময়ে সিপিএমের লাল দুর্গ হিসাবে পরিচিত ভাঙড় তৃণমূলের সবুজ দুর্গে পরিণত হয়। কিন্তু তারপরেও নিজেদের শক্তি ধরে রাখতে পারেনি তৃণমূল। ২০০৬ সালে সারা রাজ্যে যখন সিপিএম ক্ষমতায়, তখন ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। বিধায়ক হন আরাবুল ইসলাম। ২০১১ সালে যখন পালাবদল হয়, তখন সারা রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় এলেও ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রটি তৃণমূলের হাতছাড়া হয়। জয়ী হয়েছিলেন সিপিএমের বাদল জমাদার।
আরাবুলের বিরোধিতা করেসে সময়ে ভাঙড়ে দলের এক শীর্ষ নেতা নান্নু হোসেন নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে যান। তৃণমূল হেরে যায়। ২০১৬ সালে আবার এই কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হন সিপিএম থেকে আসা রেজ্জাক মোল্লা। সে সময়ে রেজ্জাকের বিরোধিতা করেছিল দলের একাংশ। ২০২১ সালেআবারও ভাঙড় বিধানসভা হাতছাড়া হয় তৃণমূলের।
তৃণমূলের কিছু নেতার দাবি, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভাঙড় ১ ব্লকের প্রভাবশালী নেতা কাইজার আহমেদ গোষ্ঠীর বিরোধ চরমে ওঠে ব্লক যুব তৃণমূলের সভাপতি বাদল মোল্লা গোষ্ঠীর। বাদল মোল্লার উপরে বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে কাইজার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। বাদল জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। দীর্ঘ দিন আদালতের নির্দেশে এলাকাছাড়া ছিলেন কাইজার।
ব্লক নেতৃত্বের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে পুরনো তৃণমূল কর্মী বিনয় ঘোষ, নিখিল সর্দার, হাকিম মোল্লা, মোফাজ্জেল গাজির মতো অনেকে বসে যাওয়ায় বিরোধীদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে করেন দলেরই অনেকে। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে কাইজার আহমেদ-সহ ভাঙড়ের একাধিক তৃণমূল নেতা টিকিটের দাবিদার ছিলেন। ‘বহিরাগত’ রেজাউল করিমকে প্রার্থী করে দল। অভিযোগ, দলের নির্দেশ অমান্য করে ভাঙড়ের প্রথম সারির বেশ কয়েক জন নেতা রেজাউলের বিরোধিতা করেন। তিনিও হারেন। সম্প্রতি বড়ালির বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা ফজলে করিমের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে গুলিবৃষ্টি, বোমাবাজির ঘটনায় নাম জড়ায় কাইজার-সহ তাঁর অনুগামীদের।
সম্প্রতি ভাঙড়ের পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করা হয়েছে ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক সওকাত মোল্লাকে। তিনি ভাঙড়ের যুযুধান সব নেতৃত্বকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার জন্য নিয়মিত মিটিং, মিছিল করছেন। ব্লকের উপরতলার নেতাদের কিছুটা এক জায়গায় আনা গেলেও বুথস্তরে আকচা-আকচি রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ।
ভাঙড় ১ ব্লক তৃণমূলের কোর কমিটির নেতা বাহারুল ইসলাম বলেন, ‘‘একদিকে ধর্মীয় ভাবাবেগ এবং আমাদের দলের কিছুগদ্দারের কারণে বিধানসভায় আমরা হেরেছি।’’ ভাঙড় ১ ব্লক তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ কাইজার আহমেদ বলেন, ‘‘আমাদের কিছু ভুলত্রুটির কারণে ভাঙড়ে আইএসএফ জিতেছিল। নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে আমরা সংগঠন মজবুত করেছি। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের ব্লক এলাকায় বিরোধীরা কোনও ভাবে দাঁত ফোটাতে পারবে না।’’
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রায় ৩৮ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিল। আইএসএফ পেয়েছিল ১ লক্ষের বেশি ভোট। এক সময়ে ধর্মগুরু বলে পরিচিত আব্বাস সিদ্দিকী সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ভাঙড়ের মাটি থেকেই আইএসএফ দল তৈরির কথা ঘোষণা করেন। ধর্মীয় পরিচয় ছেড়ে আইএসএফ ক্রমশ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে পায়ের তলায় মাটি পেতে থাকে ভাঙড়ে। বিধানসভা ভোটে জয়ী হন নওশাদ সিদ্দিকী। তারপর থেকে তৃণমূলের সঙ্গে তাদের বার বার ঝামেলা-মারপিট বেধেছে। কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে এই এলাকায় কড়া টক্কর দিচ্ছেন আইএসএফ কর্মীরা। কয়েক মাস আগে একটি মাদ্রাসা ভোটেও জয়ী হয় আইএসএফ। আইএসএফ জেলা সভাপতি আব্দুল মালেক মোল্লা বলেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা রয়েছে। তবে মানুষ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।’’
এক সময়ে সিপিএমের ‘লালদুর্গ’ ভাঙড়ে ইদানীং অনেকটাইস্তিমিত সিপিএমের কর্মকাণ্ড। তবে দলের রাজ্য কমিটির সদস্য তুষার ঘোষ বলেন, ‘‘তৃণমূল নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত। মানুষ তাঁদের থেকেমুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রতিটি বুথে আমরা শক্তিশালী প্রতিরোধগড়ে তুলব।’’
বিজেপি গত বিধানসভা ভোটে এখানে ছিল তৃতীয় স্থানে। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে কতটা ভাল করবে দল? বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য সুনীপ দাসের কথায়, ‘‘ভাঙড় ১ ব্লকের কিছু অঞ্চলে আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তবে সুষ্ঠ নির্বাচন হলে আমরা তাড়দহ ও চন্দনেশ্বর ২ পঞ্চায়েতে ভাল ফল করব।’’