নিজেই খাদ্যসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন খোকন। নিজস্ব চিত্র
বয়স তখন মাত্র তিন। পোলিওয় আক্রান্ত হয়ে অকেজো হয়ে যায় দু’টি পা। দরিদ্র পরিবারে জন্মানোর কী যন্ত্রণা, তখন থেকেই হাড়ে-হাড়ে বুঝেছিলেন খোকন মণ্ডল। কিন্তু আজ তিনি নিজের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। এবং শুধু তাই নয়, করোনা সংক্রমণের জেরে যখন দেশ জুড়ে লকডাউন চলছে তখন বছর চৌতিরিশের এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যুবকই বহু মানুষের অন্যতম ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
কী করছেন খোকন? সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরিব, দুঃস্থদের হাতে ত্রাণসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন তিনি।
জীবনতলা থানার অন্তর্গত মঠেরদিঘি গ্রামে জন্ম খোকনের। ছোটবেলাতেই মা মারা যান। পোলিও আক্রান্ত হওয়ায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না খোকন। ছোট থেকেই ক্রাচে ভর দিয়ে পথচলা শুরু। কিন্তু কখনও হার মানেননি। ছোট থেকেই নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে ক্রাচে ভর দিয়েই নানা ধরনের কাজ করেছেন। শেষ পর্যন্ত বিএ পাস করার পর দূরশিক্ষার মাধ্যমে ‘সোশ্যাল ওয়ার্কে’ এমএ করেন। এখন ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’তে কর্মরত।
ছেলেবেলা থেকেই ভাতের কষ্ট তিনি দেখেছেন। অনুভব করেছেন গরিব হয়ে জন্মানোর যন্ত্রণা। তাই যখনই আশপাশের মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য কষ্ট পাচ্ছেন বলে শুনতে পান, তখনই তাঁদের জন্য চাল-ডাল নিয়ে হাজির হন তিনি।
লকডাউনের ফলে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামগুলিতে দরিদ্র মানুষগুলি খাবারের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। সেই খবর পেয়েই কী ভাবে তাঁদের কাছে খাবার পৌঁছে দেবেন, তা ভাবতে শুরু করেন খোকন। যোগাযোগ করেন নিজের কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। সেই বন্ধুদের সহযোগিতাতেই শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের দুঃস্থদের কাছে, যেখানে এখনও সরকারি সাহায্য পৌঁছতে পারেনি, সেখানে হাজির হয়ে তাঁদের সাহায্য করছেন খোকন।
রবিবার সুন্দরবনের বাসন্তী ব্লকের কুলতলি গ্রামের এরকম প্রায় ৫০টি পরিবারের হাতে চাল-ডাল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও শিশুদের জন্য দুধের প্যাকেট তুলে দেন খোকন। ক’দিন আগেই ক্যানিংয়ের জয়রামখালি, ডাবু, নিকারিঘাটা এলাকাতেও প্রায় দু’শো পরিবারের হাতে চাল-ডাল তুলে দিয়েছেন।
তবে শুধু লকডাউনের সময়েই যে তিনি এমন কর্তব্য পালন করছেন, তা নয়। সারা বছর ধরেই এলাকার দুঃস্থ মানুষের পাশে থাকেন তিনি। এ কাজে তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর বন্ধু অর্পণ দাস, ছায়া মণ্ডল, শুভ দাসেরা। খোকন বলেন, “ছোট থেকে দু’টো ভাতের জন্য বড্ড কষ্ট পেয়েছি। তাই কেউ ভাতের জন্য কষ্ট পাচ্ছে শুনলে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি।”
তবে, দুঃস্থদের জন্য দু’বেলা ভাতের সংস্থানই শুধু লক্ষ্য নয় খোকনের। সুন্দরবন এলাকার দরিদ্র মানুষ যাতে আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন, সেজন্য তাঁদের নিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করেন খোকন। তাঁদের বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শেখানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা যাতে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষিকাজে করতে পারেন, সেদিকটাও খেয়াল রাখেন। আবার পাশাপাশি, শারীরিক ভাবে অক্ষমদের মানসিক ভাবে দৃঢ় করে গড়ে তোলার কাজও করে থাকে তিনি।