বিপদ মাথায় নিয়ে রোজ এমন ঝুঁকি নিয়েই চলে ওঠানামা।—নিজস্ব চিত্র।
বিপজ্জনক সাঁকো, দুর্ঘটনাপ্রবণ জেটি আর ঘাটে নামার জন্য শ্যাওলা ধরা পিছল সিঁড়ি। বর্ষার সময় এমনই দশা হয় ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ফেরিঘাটগুলির।
জগদ্দলের কাউগাছির বাসিন্দা স্কুলছাত্রী শিল্পা পাল বা বরাহনগর কুঠিঘাটের দেবাশিস ঘোষ বর্ষাতেই ফেরি পারাপারের সময় নৌকো থেকে নামার সময় পড়ে পা ভেঙেছিলেন। বরাহনগর বা শ্যামনগরের ফেরিঘাটের কর্মীরা অবশ্য এ সব ক্ষেত্রে যাত্রীদের চিকিৎসার ব্যবস্থাটুকু করেছিলেন। বেসরকারি সংস্থার কর্মী দেবাশিসবাবুর অফিস হাওড়ায়। টানা এক মাস ছুটিতে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। আর শিল্পার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। স্কুল কামাই করে বাড়িতে শুয়ে থাকা ছাড়া তারও কোনও উপায় ছিল না। যাত্রীরা জানান, এমন অবস্থা থাকলে পারপারের সময় বড় কোনও দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। সে কারণে বিপদ এড়াতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এ বার তদ্বির করছেন ফেরিঘাটগুলি নিয়ে।
তাঁরই নির্দেশে সম্প্রতি শিল্পাঞ্চলের ফেরিঘাটগুলির দৈন্যদশা আর তার সংস্কার নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলাশাসকের দফতরে। ফেরি ঘাটগুলির বিপজ্জনক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রশাসনও। ইতিমধ্যে যাত্রী পরিষেবার উন্নতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জলপথ পরিবহণ দফতরকে। তারই প্রাথমিক পদক্ষেপ করতে এই প্রশাসনিক বৈঠক বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা।
জলপথ পরিবহণ দফতরের এক আমলা বলেন, ‘‘ফেরি ঘাটগুলি তৈরি হওয়ার পর থেকে আজ অবধি কোনও পরিবর্তন হয়নি শুধুমাত্র যথাযথ সংস্কারের অভাবে। এখন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তড়িঘড়ি আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। নতুন করে সব পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’’ ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক পীযূষ গোস্বামী বলেন, ‘‘বর্ষায় প্রতিটি ফেরিঘাটে পর্যাপ্ত আলো এবং বৃষ্টিতে যাত্রী পারাপারের সময় যথাযথ নিরাপত্তার বিষয়টিতেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ঘাটগুলি যে যে পুর এলাকায় তার প্রতিনিধি এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’’
প্রত্যেক বছর শিল্পাঞ্চলের ১৯টা গুরুত্বপূর্ণ ফেরিঘাটে দুর্ঘটনার প্রবণতা থাকে মূলত বর্ষাকালে। নৌকোয় উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ঘটনা এই সময়েই বেশি। ঘাটগুলির ইজারাদারদের কথায়, ‘‘পড়ে জখম হওয়ার ঘটনা সব থেকে বেশি হয় ঝিরঝিরে বৃষ্টিতেই। তাড়াহুড়ো আর অসতর্কতায় ফি বছর এমন পা হড়কে পড়ে জখম হওয়ার গড় হিসাব ২০-২২টি।’’
এই ফেরিঘাটগুলি দিয়ে প্রত্যেকদিন লক্ষাধিক যাত্রী পারাপার করেন। দিনে কয়েক লক্ষ টাকা আয় হয় জলপথ পরিবহণে। পরিবহণ আইন অনুযায়ী, ওই টাকার একটা অংশ খরচ করার কথা যাত্রী পরিষেবায়।
কিন্তু বাস্তবের ছবিটা অন্য রকম। বছরের পর বছর অস্থায়ী জেটি আর কাঠ-বাঁশের নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করাটাই ব্যারাকপুর ও হুগলি গঙ্গার দু’পারের দুই শিল্পতালুকের যাত্রীদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ওজন যন্ত্র ছাড়াই যাত্রীদের সঙ্গে থাকা সুটকেস বা বড় ব্যাগের মতো মালপত্র নৌকোয় তোলা হয়। তার জন্য খেয়াল খুশিমতো টাকাও নেওয়া হয়। বিনা নোটিসে যাত্রী পারাপারের সময় বদলানো হয়। আবার কখনও পারাপার বন্ধও থাকে। তা ছাড়া অধিকাংশ ঘাটে শৌচাগার বা পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি জেটির অবস্থাও খারাপ। এর প্রতিকারেই ওই বৈঠক করা হয়েছে।
বিপদ এড়াতে প্রতিটি ঘাটে লাইফ জ্যাকেট, সি সি ক্যামেরা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়েছে। মহকুমাশাসকের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কর্তারা ইতিমধ্যেই ধোবি ঘাট, শ্যামনগর ঘাট, জগদ্দল ঘাট, কামারহাটি ঘাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলো সরেজমিনে দেখেছেন।