বনগাঁ লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর জয়ী হয়েছেন ১,০৯,৮৫৫ ভোটের ব্যবধানে। নিকটতম তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর পেয়েছেন ৫,৭৫,৩৮২টি হাজার ভোট। শান্তনু পেয়েছেন ৬,৮৫,২৩৭ ভোট। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বনগাঁ লোকসভা অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬টিতেই তৃণমূল পিছিয়ে। মমতা ঠাকুর নিজের বুথেও পিছিয়ে আছেন।
বিজেপি লিড পেয়েছে বাগদা, বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ, গাইঘাটা, কল্যাণী ও হরিণঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। একমাত্র স্বরূপনগর বিধানসভা থেকে তৃণমূল প্রার্থী লিড পেয়েছেন। এই বিধানসভা থেকে মমতা ২৪,১৫১ ভোটের লিড পেয়েছেন। শান্তনু সব থেকে বেশি লিড পেয়েছেন গাইঘাটা বিধানসভা থেকে। এখানে ৩৫,৯৪৮ ভোটের মার্জিনে এগিয়ে তিনি। এই বিধানসভা এলাকাতেই বাড়ি শান্তনুর।
বর্তমানে বাগদা ছাড়া সব ক’টি বিধানসভা তৃণমূলের দখলে। তা হলে কেন এমন ভরাডুবি ঘাসফুল শিবিরের?
প্রাথমিক ভাবে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে তৃণমূল মনে করছে, বামেদের বেশির ভাগ ভোটই বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়ায় এই হাল। পাশাপাশি মতুয়া ভোট ধরে রাখতে না পারাও পরাজয়ের কারণ হয়েছে। গত লোকসভা ভোটে বামেরা পেয়েছিল ২৬ শতাংশ ভোট। এ বার তা নেমে এসেছে ৬.৪১ শতাংশ ভোটে। সিপিএম প্রার্থী অলকেশ দাস কোনও বিধানসভা থেকে ২৫ হাজার ভোটও পাননি। তিনি সব থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন স্বরূপনগর বিধানসভা থেকে। এখানে তাঁর প্রাপ্ত ভোট ২২,৭৯৭। অলকেশের বাড়ি কল্যাণীতে। সেখান থেকে তিনি পেয়েছেন মাত্র ১৬,৮৯৩টি ভোট।
কেন বামেরা তাদের ভোট ধরে রাখতে পারল না?
সিপিএমের উত্তর ২৪ জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে বুথে বুথে তৃণমূলের সন্ত্রাস, বাম কর্মী-সমর্থকদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর কারণে মানুষ এককাট্টা হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। কারণ, কর্মী-সমর্থকদের মনে হয়েছিল, তৃণমূলের অত্যাচারের হাত থেকে তাঁদের বাঁচাতে যে ভরসা আমাদের দেওয়া উচিত ছিল, তা আমরা দিতে পারিনি। কেন্দ্রে বিজেপি থাকায় মানুষের মনে হয়েছে, ওই দলই তাঁদের আশ্রয় দিতে পারবে।’’ যদিও নিজেদের ভোট ধরে রাখতে না পারাটা উদ্বেগজনক ঘটনা বলেই মনে করছেন অলকেশ।
বনগাঁ লোকসভার সাতটি বিধানসভা এলাকাতেই মতুয়া ভোটারদের প্রভাব রয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন। পরিসংখ্যান বলছে, মমতা ঠাকুরের থেকে এ বার শান্তনুকেই বেশিরভাগ মতুয়া বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। কয়েকজন মতুয়া ভক্তের কথায়, ‘‘ঠাকুর পরিবারের রক্ত যাঁর শরীরে বইছে, আমরা তো তাঁর দিকেই থাকব।’’ প্রসঙ্গত, শান্তনু মতুয়া বাড়ির ছোট নাতি। অন্য দিকে, মমতা ঠাকুর, বাড়ির বড় বৌমা।
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র এলাকায় বহু উদ্বাস্তু মানুষ বসবাস করেন। তাঁরা কোনও না কোনও সময়ে এ দেশে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি তাঁরা আস্থা রেখেছেন। ঠাকুরনগরে এসে উদ্বাস্তুদের এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে দাবি করে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তৃণমূল প্রতিটি বিধানসভা এলাকায় এনআরসি নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারে নামলে মানুষ তা গ্রহণ করেনি বলেই মনে করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, মেরুকরণের রাজনীতি এ বারের ভোটে বনগাঁ কেন্দ্রেও প্রভাব ফেলেছে। স্বরূপনগর বিধানসভা এলাকায় সংখ্যালঘু মানুষের বসবাস তুলনায় বেশি। সেখানে তৃণমূল ভাল ফল করেছে। কল্যাণীতে নতুন শিল্প কারখানা না হওয়া ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নে মানুষ বিজেপির দিকে ঝুঁকেছেন। এ ছাড়া, এখানে কেন্দ্র এমস তৈরি করছে। তৃণমূলের একটি সূত্রে জানাচ্ছে স্থানীয় স্তরে দলের নেতা-কর্মীদের আচার-আচরণও মানুষ ভাল চোখে দেখেননি। নেতাদের সর্বত্র প্রচারে গা ঘামাতে দেখা যায়নি। স্থানীয় নেতৃত্ব জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছেন বলেও দলের একাংশের মত। তৃণমূল কর্মীদের কারও কারও কথায়, ‘‘নেতা, জনপ্রতিনিধিরা গাড়ির কাচ তুলে যাতায়াত করেন। চায়ের দেকানে বসে তাঁদের আর আড্ডা মারতে দেখা যায় না। দলীয় কোন্দলও রয়েছে।’’
তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘কেন এমন ফল, আমরা বিশ্লেষণ করে দেখছি। তবে সিপিএমের ভোট বিজেপিতে চলে যাওয়া হারের প্রধান কারণ। উদ্বাস্তু মানুষের ভোটও আমরা পাইনি।’’ বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ থেকে মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। শুধু সিপিএমের ভোট পাওয়াই কারণ নয়। পঞ্চায়েতে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও মানুষ আমাদের
ভোট দিয়েছেন।’’