বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে ইলিশ মাছ ধরার উপরে নিষেধাজ্ঞা থাকে। কিন্তু প্রতি বারই দেখা যায়, লুকিয়ে-চুরিয়ে সে সময়টা ইলিশ ধরছেন মৎস্যজীবীরা। বার বার তাঁদের সচেতন করার চেষ্টা হয়েছে সরকারের তরফে। বলা হয়েছে, এপ্রিলের ১৫ তারিখের পর থেকে পরবর্তী দু’মাস পর্যন্ত ইলিশ না ধরলে আখেরে লাভ মৎস্যজীবীদেরই। কারণ, এই সময়টা হল ইলিশের প্রজননের সময়। ছোট ইলিশকে বড় হতে দেওয়ার জন্যও নির্দিষ্ট একটা সময় দরকার।
কড়া শাস্তির বিধান না থাকায় মৎস্যজীবীরা কথা কানে তোলেন না বলে অনুমান মৎস্য দফতরের কর্তাদের একাংশেরও। এ বছর বিষয়টি নিয়ে সরকারের তরফে আইনি পদক্ষেপ করার কথা থাকলেও তেমনটা হয়নি। ফলে এ বছরও লুকিয়ে বাচ্চা ইলিশ ধরার প্রবণতা কমবে না বলে আশঙ্কা।
মৎস্যকর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন, বিধিতে আমূল পরিবর্তন এনে তা কড়া করতে হবে। কিন্তু এক বছরে আরও একটি কমিটি তৈরি হয়েছে মাত্র। আর কিছুই হয়নি।
মৎস্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সামুদ্রিক মৎস্য শিকার আইনের বিধিতে বদল আনার জন্য এ বছর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়া হয়েছে। ডেপুটি মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) সন্দীপ মণ্ডল জানান, জরিমানার অঙ্ক বাড়ানো, প্রয়োজনে আরও কড়া সাজার বিধান রাখা, সমুদ্রের একেবারে তলায় জাল ফেলা ট্রলি (বটম ট্রলিং), মৎস্য বন্দরগুলি নিয়ে নির্দেশিকা বদলের মতো অনেকগুলি বিধি এক সঙ্গেই বদলাতে হবে বলে দেরি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক ডেকে দ্রুত সেগুলি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। সেই কমিটির সুপারিশ জমা পড়লে তবে বিধি বদল হতে পারে। অর্থাৎ, তাতে আরও অনেকটাই সময় চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছে মৎস্যজীবী সংগঠনগুলি।
মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের দাবি, সামুদ্রিক মৎস্য শিকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় অনেক আইন জড়িয়ে রয়েছে। তাই এখন যে কোনও প্রস্তাব দিতে গেলেই তা নাকচ হচ্ছে। সে কারণে রাজ্য সরকারের আইনেই যা করার করতে হবে। চন্দ্রনাথবাবুর কথায়, ‘‘একটু দেরি হচ্ছে বটে। তবে ইলিশ বাঁচাতে বিধিতে জরুরি বদলের কাজ হবেই।’’
ইলিশের সংরক্ষণের পুরনো বিধি অনুযায়ী বেআইনি মাছ এই সময়ে যদি ধরা পড়ে, তা হলে তা নিলাম করে তার ৫০ শতাংশ টাকা আবার সেই মৎস্যজীবীকেই দেওয়ার বিধান রয়েছে। মনোফিলামেন্ট বা ছোট ফাঁসের জাল ধরা পড়লে সেগুলি আবার নিলাম করে বাজারেই বিক্রি করার বিধি রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ মৎস্যজীবী সংগঠনগুলির দাবি, এ সব পুরনো নিয়মের জেরেই ইলিশের চোরাশিকারি মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে কড়া সাজার নজির তৈরি করা যাচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না ইলিশের চোরা কারবার।
পশ্চিমবঙ্গ ইউনাইটেড ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতা বিজন মাইতি জানান, সরকারকে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ধরা পড়া মাছের নিলামে ৫০ শতাংশ টাকা আইন ভাঙা ওই মৎস্যজীবীকে দেওয়ায় ঘোর আপত্তি ছিল তাঁদের। প্রথমবার ধরা পড়লে জরিমানা, দ্বিতীয় বার ট্রলারের অনুমোদন বাতিল এবং তৃতীয় বার কারাদণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব ছিল মৎস্যজীবীদের।
তবে শুধু আইন-সংক্রান্ত সমস্যার জন্যই যে ছোট ইলিশ ধরা বন্ধ হচ্ছে না, তা নয়। মৎস্য দফতরের পরিকাঠামোও বেশ নড়বড়ে। কর্মী কম। নিয়মিত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ৩৭টি নথিভুক্ত ফিশ ল্যান্ডিং ঘাটে নজরদারি চালানো মুশকিল। শক্তিশালী জলযানের অভাব আছে। মৎস্য বন্দরগুলিতে নিয়মিত ভাবে মৎস্যকর্তাদের উপস্থিতি রাখা প্রায় নেই বললেই চলে। লোকবল কম থাকায় কোথাও বেআইনি মাছ ধরা হয়েছে জানতে পারলেও মৎস্যকর্তারা সময়ে পৌঁছতে পারেন না।
সব মিলিয়ে এখনও ছোট ইলিশের প্রাণ সংশয়ে।