সুনসান সব...

মাছি তাড়াচ্ছে টাকি-বকখালি

নোটের গুঁতোয় টালমাটাল দুই ২৪ পরগনার পর্যটন ব্যবসা। নগদে টান পড়ার জেরে মুখ ঘুরিয়েছেন পর্যটকেরা। তার জেরে ভরা পর্যটন মরসুমেও প্রায় ফাঁকা রয়েছে দুই জেলার অন্যতম দুই পর্যটন কেন্দ্র টাকি এবং বকখালি।

Advertisement

নির্মল বসু ও শান্তশ্রী মজুমদার

টাকি ও বকখালি শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:২৩
Share:

শীতের শুরুতেই জনশূন্য টাকী। পর্যটকের দেখা নেই বিধান সৈকতে।

নোটের গুঁতোয় টালমাটাল দুই ২৪ পরগনার পর্যটন ব্যবসা। নগদে টান পড়ার জেরে মুখ ঘুরিয়েছেন পর্যটকেরা। তার জেরে ভরা পর্যটন মরসুমেও প্রায় ফাঁকা রয়েছে দুই জেলার অন্যতম দুই পর্যটন কেন্দ্র টাকি এবং বকখালি। অন্যান্য ছুটির দিনের তুলনায় শনিবার দু’জায়গাতেই পর্যটক ছিল হাতেগোনা। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশ জানিয়েছেন, টাকার আকাল পুরোপুরি না মিটলে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র দু’টিতে চেনা ছন্দ ফিরবে না৷

Advertisement

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ছোট্ট শহর টাকি গড়ে উঠেছে ইছামতী নদীর তীরে। নদীর ঠিক ওপারেই বাংলাদেশ। বছরের যে-কোনও সময়েই, বিশেষ করে সপ্তাহ শেষে শনিবার টাকিতে আসেন পর্যটকেরা। রবিবার চলে যান। কেউ কেউ আবার শুক্রবার এসে রবিবার যান। শীতের মরসুমে এই পর্যটনকেন্দ্রের হোটেল এবং গেস্ট হাউসগুলিতে জায়গা পাওয়াই দুষ্কর। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত বদলে গিয়েছে সব কিছু। মাঝ নভেম্বরের শনিবাসরীয় দুপুরে টাকিতে পর্যটক নেই বললেই চলে! গেস্ট হাউস, হোটেল ফাঁকা।

টাকির পুরপ্রধান সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘খুচরোর অভাবে পর্যটক অস্বাভাবিক ভাবে কমে গিয়েছে। পুরসভা পরিচালিত গেস্ট হাউসের কর্মীদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। খুচরোর অভাবে ভ্যান রিকশা, টোটো চালকরা যাত্রী পাচ্ছেন না। খাবার দোকানেও ভিড় নেই। এ রকম চলতে থাকলে টাকি পর্যটন শিল্পে বড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।’’

Advertisement

শনিবার দুপুরে ইছামতী ধারের পার্কে গিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকজন বসে রয়েছেন। পার্ক খাবারের দোকানের মালিক নিতাই হালদার, বুদ্ধদেব ঘোষদের আক্ষেপ, ‘‘অন্যান্য বছরগুলিতে এই সময়ে শনিবার এবং রবিবার দুপুরে কম করে ১০০০ টাকার বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু আজ ৩০-৪০ টাকার বেশি বিক্রি হয়নি। গত কয়েক দিন ধরেই খুচরো না থাকার কারণে এই সমস্যা চলছে।’’ তবে তুলনায় আশাবাদী ওই এলাকার দোকানি বিপুল মজুমদার, অর্ণব মুখোপাধ্যায়রা। তাঁদের দাবি, ‘‘এখন সমস্যা হচ্ছে বটে, কিন্তু ডিসেম্বরের শুরুতে পরিস্থিতি বদলে যাবে।’’ স্থানীয় ভ্যান চালক আব্দুল সালাম, ইসমাইল গাজিদের আক্ষেপ, ‘‘সকাল থেকে বসে রয়েছি। খুচরো দিতে পারছি না বলে একটাও ভাড়া হয়নি।’’ আব্দুল গাজি, উৎপল দাস-সহ কয়েকজন ভ্যান চালক জানালেন, অনেকেই ৫০০ টাকা দিতে চাইছে। কিন্তু ওই নোট বাজারে ভাঙাতে গেলে ৫০ টাকা বাট্টা দিতে হচ্ছে।

পর্যটকের দেখা নেই বকখালির সমুদ্রসৈকতে।

টাকি পুরসভা পরিচালিত একটি গেস্ট হাউসের ম্যানেজার কাশীনাথ মল্লিক জানালেন, তাদের ১০টি ঘরের মধ্যে মাত্র ৩টি ঘরে পর্যটক রয়েছেন। অন্য একটি গেস্ট হাউসের ম্যানেজার সুকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘খাতায় কলমে এখন ১৬টি ঘর বুকিং রয়েছে। কিন্তু মাত্র ৪টি ঘরে পর্যটক এসেছেন।’’ খুচরোর অভাবে হোটেল কর্মীদের টিপ্‌সেও টান পড়েছে।

কলকাতার টালিগঞ্জ থেকে টাকিতে ঘুরতে এসেছেন কল্পনা মুখোপাধ্যায়, রতন ঘোষ। তাঁদের কথায়, ‘‘টাকিতে আসব বলে দু’মাস আগে ঘর বুক করেছিলাম। কিছুটা বাধ্য হয়েই এসেছি। বেড়াতে এসেও খুব মেপে খরচ করতে হচ্ছে।’’

শনিবাসরীয় দুপুরে প্রায় টাকির মতোই অবস্থা সমুদ্র-সৈকত বকখালির। এমনিতেই গোটা বকখালিতে এটিএমের সংখ্যা সাকুল্যে একটি। সেখানে স্বাভাবিক সময়েও লিঙ্ক সমস্যা থাকে। মাঝে মধ্যেই বিঘ্ন ঘটে বার্জ চলাচলে। তার উপরে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত যেন এই সৈকত শহরে বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়ার মতো ঘটনা। হোটেল ব্যবসায়ীদের দাবি, নোট বাতিলের পরে বকখালিতে পর্যটক সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এখানকার কয়েকটি হোটেলে অবশ্য এখনও পুরনো ৫০০-১০০০ টাকার নোট নেওয়া হচ্ছে।

এ দিন দুপুরে সমুদ্র সৈকত এবং সৈকত লাগোয়া খাবারের দোকানগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন মেরেকেটে শ’খানেক পর্যটক। সমুদ্রের ধারে ফাঁকা পড়ে রয়েছে সারি সারি চেয়ার এবং রোদ-ছাতা। পর্যটন দফতরের সরকারি লজ প্রায় ফাঁকা। ওই লজের ম্যানেজার সোমনাথ দত্ত বলেন, ‘‘গত সপ্তাহ থেকে অর্ধেকের বেশি বুকিং বাতিল হয়ে গিয়েছে। কার্ডে টাকা দেওয়ার সুবিধা থাকলেও বেশিরভাগ সময়েই ইন্টারনেট লিঙ্ক থাকে না।’’ তিনি জানান, বাধ্য হয়ে কয়েকটি ক্ষেত্রে ৫০০-১০০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি বেসরকারি হোটেলেও ৫০০-১০০০ টাকা চলছে। বকখালি বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এক খাবার হোটেলের ম্যানেজার শম্ভুনাথ প্রামাণিক বলেন, ‘‘পুরনো নোট চলছে। তবে ৫০০ দিলে কমপক্ষে ৩০০ টাকার খাবার খেতেই হবে। তা না হলে খুচরো দিতে পারব না।’’

লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে বকখালি এসেছিলেন এক দম্পতি। তাঁদের কথায়, ‘‘দু’জনে মিলে কত খাবো যে ৩০০ টাকা বিল হবে! তাই এখন ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ কলকাতার ঠাকুরপুকুর থেকে এসেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কিশোরকুমার ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘টাকা খুচরো করাতে পারছি না। একমাত্র এটিএমেও টাকা শেষ।’’

বাসস্ট্যান্ড-লাগোয়া একটি হোটেলের ম্যানেজার বাসুদেব ধাড়ামি জানালেন, বাধ্য হয়ে ঘরের দর কমিয়ে দিয়েছে অনেক হোটেল। অথচ গত বছরেও মাঝ নভেম্বরের বকখালিতে বুকিং না করে এলে হোটেলের ঘর পেতে ঘাম ছুটে যেত। হোটেল ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধু নভেম্বর নয় ডিসেম্বরের বুকিংও বাতিল করা হচ্ছে। হোটেল ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তা অপূর্ব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নভেম্বরের গোড়াতেই ডিসেম্বরের জন্য হোটেলগুলিতে বুকিং শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এ বার সেটা একেবারেই হচ্ছে না। উল্টে বুকিং বাতিল হয়ে যাচ্ছে।’’

পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে? টাকি এবং বকখালির হোটেল ব্যবসায়ী থেকে চায়ের দোকানি সকলের মুখে মুখে এখন ঘুরছে এই প্রশ্নই।

শনিবার টাকি ও বকখালিতে তোলা নিজস্ব চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement