উদ্বোধন: মেলার। শুক্রবার সন্ধ্যায়। ছবি: প্রসেনজিৎ সাহা
শীতের সন্ধ্যায় নাগরদোলায় চড়া কিংবা গান শুনতে শুনতে বেলুন কিনে ঘরে ফেরার চিরাচরিত ছবির বাইরে নিজের পৃথক পরিচয় তৈরি করেছে সুন্দরবন কৃষ্টি মেলা ও লোকসংস্কৃতি উৎসব। কখনও মেলার মঞ্চ থেকে দাবি উঠেছে, এলাকায় কলেজ তৈরি হোক। কখনও নদীর উপরে সেতু চেয়ে মেলায় আসা বিশিষ্ট অতিথির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে গণস্বাক্ষর করা দাবিসনদ। কখনও সেই দাবি পূরণ হয়েছে, কখনও হয়নি। কিন্তু গত তেইশ বছর ধরে সুন্দরবনের মানুষের চাহিদা আর দাবির কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয়েছে এই মেলাকে ঘিরে।
১৯৯৭ সালে দক্ষিণ সুন্দরবনের বাসন্তী ব্লকের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কুলতলি মিলনতীর্থ সোসাইটির আয়োজনে শুরু হয়েছিল এই মেলা। যার জন্মলগ্ন থেকেই উদ্যোক্তারা জানিয়েছিলেন, সুন্দরবনের মানুষের অপূর্ণ দাবিপূরণ এবং বাদাবনের সংস্কৃতির বিকাশকে সামনে রেখে গোটা আয়োজন সাজাবেন তাঁরা।
উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান তথা সমাজকর্মী লোকমান মোল্লার উদ্যোগ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়। তিনি বলেন, ‘‘নানা দিক থেকে বঞ্চিত, নিপীড়িত সুন্দরবনের মানুষ এমন একটা মঞ্চ চাইছিলেন, যেখানে কোনও রাজনীতির রং থাকবে না। কোনও বৈষম্য থাকবে না। মানুষ মুক্তমনে নিজের দাবির কথা তুলে ধরতে পারবেন এখানে।’’ মেলার উদ্যোক্তারা মনে করেন, শুধু সুন্দরবনের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়ই তাঁদের নেই, পাশাপাশি এখানকার মানুষের জীবনের সামগ্রিক মানোন্নয়নের জন্য তাঁরা ব্যবহার করবেন এই মঞ্চকে।
হয়েওছে তাই।
নব্বই শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত বহু এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, সে সময়ে তৎকালীন ওয়েবরেডা অধিকর্তা ‘গ্রিন অস্কার’ বিজয়ী শান্তিপদ গণচৌধুরীকে মেলার মঞ্চে হাজির করে সৌরশক্তির মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি আলো জ্বালানোর দাবি তুলে ধরেছিল এই মেলা। পরবর্তী সময়ে দেশের মধ্যে প্রথম নফরগঞ্জ, বিরিঞ্চিবাড়ি, বড় দিন্দারঘেরি, দক্ষিণ গরানবোস গ্রামে সৌরবিদ্যুতে বাড়িতে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা চালু হয়। সে সময়ে উদ্বোধন করতে এসেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অচিরাচরিত শক্তি মন্ত্রী। রেভিনিউ আদায়ের জন্য মিলন তীর্থ সোসাইটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ে তা জমাও করেছিল সোসাইটি।
মাতলা সেতুর দাবি নিয়ে প্রশাসনের কাছে এর আগে বহু দরবার করেছিলেন মানুষ। তৎকালীন সুন্দরবন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে মেলার মঞ্চে হাজির করেন লোকমানরা। হাজার হাজার সুন্দরবনবাসীদের যাতায়াতের সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, সেতু তৈরির চেষ্টা করবেন। কয়েক বছরের মধ্যেই সেই সেতুর উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
পিছিয়ে পড়া বাসন্তী ব্লকে কোনও ডিগ্রি কলেজ ছিল না। মেলার মঞ্চে হাজার হাজার মানুষের সই করা আবেদনপত্র তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেন লোকমান। নানা টালবাহানার পরে ২০০৮ সালে সুকান্ত কলেজের অনুমোদন দেয় রাজ্য।
মেলার মঞ্চে ভারত সরকারের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার (টেলিকম) নিশিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপস্থিত করে টেলিফোন একচেঞ্জ তৈরির দাবি তোলা হয়। নিশিনাথ হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রতিশ্রুতি দেন। এক বছরের মধ্যে কুলতলিতে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের উদ্বোধন হয়। বাসন্তী ব্লকে আরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চেয়ে দাবি ওঠে কোনও এক বছর। এক সঙ্গে বাসন্তী ব্লকে ১৮টি জুনিয়র হাইস্কুলের অনুমোদন দেয় রাজ্য। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটির অনুমোদন মেলে।
পানীয় জল প্রকল্প, শৌচাগার, আইটিআই কলেজ— নানা সময়ে নানা দাবি উঠেছে মেলার মঞ্চ থেকে।
লোকমান তদানীন্তন কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রী চক্রধর মেইকাপের হাতে আইটিআই কলেজের দাবিপত্র তুলে দেন। মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কেউ জমি দান করলে তবে প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে। লোকমান ফিরে এসে মেলা কমিটির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন। কমিটির অন্যতম সদস্য জয়দেব মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী নির্মলা সুন্দরবনের হতদরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের কথা ভেবে ৯ বিঘা জমি নিঃশর্তে দান করেন। এ সব ঘটনা মেলার ইতিহাসকে বর্ণময় করেছে, গৌরবও বেড়েছে। পরে আইটিআই কলেজ তৈরি হয়।
তবে অপূরণীয় দাবির সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
ক্যানিং-ঝড়খালি রেললাইন সম্প্রসারণের প্রস্তাব যেমন। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৎকালীন লোকসভার অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে মেলার মঞ্চে উপস্থিত করে লক্ষাধিক মানুষের সই করা রেলপথের দাবি জানানো হয়। সোমনাথ পর দিন দিল্লি ফিরে তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবকে চিঠি লেখেন। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনাও করেন। তবে প্রকল্পের কাজ শেষমেশ এগোয়নি। ২০১৩ সালে রেলের রাষ্ট্রমন্ত্রী অধীররঞ্জন চৌধুরীকে মেলার মঞ্চে হাজির করান উদ্যোক্তারা। বন্ধ হওয়া রেলপথের কাজ শুরু হয়। ফের থমকে যায়। হাল ছাড়ার পাত্র নন লোকমান। দিল্লিও ছোটেন এ কারণে। লক্ষাধিক মানুষের স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি নিয়ে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর কাছে জমা করে আসেন। কাজ এগোচ্ছে না। তবে মেলা কমিটি সেই দাবিতে চিঠি-চাপাটি চালিয়ে যাচ্ছে নানা দফতরে।
বাসন্তীতে দমকল কেন্দ্র নিয়েও দাবি তোলা হয়েছিল। দানের জমিও জোগাড় হয়ে যায়। কিন্তু নানা কারণে এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী যে বার এলেন মেলায়, বাসন্তী ব্লকে মেয়েদের স্কুল তৈরির স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে।
মাতলা নদীর চরে সুন্দরবন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েও গণস্বাক্ষর সম্বলিত আবেদনপত্র দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। তার প্রাপ্তি স্বীকারের চিঠি নিয়ে আজও দিল্লি দরবারে আবেদন করে যাচ্ছে মেলা কমিটি।
এ বছর মেলায় কী দাবি তুলছেন মঞ্চে?
লোকমান জানান, পুরনো অপূর্ণ দাবিগুলি অতিথিদের মনে করিয়ে দেওয়া হবে। এরই সঙ্গে বাসন্তী ব্লকে এইমসের ধাঁচে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, গ্রিন এনার্জি এফিশিয়েন্সি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার দাবিও থাকছে। সেই সঙ্গে কংক্রিটের নদীবাঁধের দাবিও থাকছে।
মেলা কমিটি মনে করে, এত বড় মঞ্চ থেকে তোলা দাবিকে গুরুত্ব দেন অতিথিরা। এত মানুষের সামনে কথা না দিয়ে অনেক সময়ে উপায়ও থাকে না তাঁদের। ফলে দাবি জানানোর এটাই সেরা সুযোগ। আর সেই সুযোগকে পুরোদস্তুর কাজে লাগিয়ে সুন্দরবনের মানুষের দাবি আদায়ের মঞ্চ হয়ে উঠেছে এই মেলা।