আলোচনায় ব্যস্ত তরুণ নেতা।— নিজস্ব চিত্র।
এক দিকে দলের অন্দরে বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর দাপট, অন্য দিকে বামেদের এক সময়ের খাসতালুকে লড়াইয়ের বাড়তি চ্যালেঞ্জ— সব কিছুই সামলাচ্ছেন বীজপুরের তরুণ বিধায়ক তথা কাঁচরাপাড়ার কাউন্সিলর তৃণমূল নেতা শুভ্রাংশু রায়। এ বার পুরভোটে বীজপুর বিধানসভা এলাকার দু’টি পুরসভা কাঁচরাপাড়া ও হালিশহরে যাঁর উপরে দায়িত্ব ছেড়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে দলের অন্দরেই চোরাস্রোত যে আছে, তা বিলক্ষণ জানেন শুভ্রাংশু। যে কারণে বিস্তর ঘাম ঝরাচ্ছেন তিনি প্রচারে। তা চোখ এড়াচ্ছে না রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয় এমন নাগরিকদেরও। দলের ঘনিষ্ঠ কর্মীদের অনেকেই বলছেন, ‘‘নিজেকে প্রমাণ করতে মরিয়া উনি। অনেক বড় দায়িত্ব দিয়েছেন ওঁকে দলনেত্রী।’’ নিজের ওয়ার্ড বাদেও হালিশহর-কাঁচরাপাড়ার সব ক’টি ওয়ার্ডে ঘন ঘন দৌড়চ্ছেন শুভ্রাংশু। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একাধিক সভা করছেন।
তৃণমূলে একদা ‘নম্বর টু’ মুকুল রায়ের ছেলে হওয়ার সুবাদে কয়েক কদম এগিয়ে থেকেই রাজনীতির মাটিতে পা ফেলেছিলেন শুভ্রাংশু। ২০১০ সালে কাঁচরাপাড়া পুরসভার ভোটে জিতে কাউন্সিলর হন। ২০১১ সালে রাজ্য জুড়ে পরিবর্তনের হাওয়ায় মুকুল-পুত্রের লড়াইটা কঠিন হয়নি বলাইবাহুল্য। জয়ী হন তিনি। কিন্তু এ বার অন্য পরিস্থিতি। প্রচারে পুরোপুরি গায়েব মুকুলবাবু। একার কাঁধে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে শুভ্রাংশুকেই।
মুকুলবাবুর সঙ্গে তখন কার্যত মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে দলনেত্রী মমতার। মুকুলবাবুকে নিয়ে নানা চোখা চোখা মন্তব্য করছেন নেত্রীর ঘনিষ্ঠরা। একের পর এক পদ থেকে সরিয়ে মুকুলবাবুকে ক্রমশই দলের পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সে সময়ে বাবার সম্মান রাখতে মুখ খোলেন শুভ্রাংশু। যা দলনেত্রীকে খুব একটা স্বস্তি দেয়নি বলাইবাহুল্য। দলের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকজন মজা দেখছিলেন তখন। কী ভাবে এ বার শুভ্রাংশুর উপরে কোপ পড়ে, তা দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা।
আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে মুকুলবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা বলে পরিচিত ভাটপাড়ার বিধায়ক অর্জুন সিংহ অতি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নিজের এলাকার বাইরে হালিশহর-কাঁচরাপাড়ায় একাধিক মিটিং-মিছিল, পথসভা করতে শুরু করেন তিনি। দলের মুকুল-ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ অর্জুন-শিবিরের দিকে ভিড়তে শুরু করেন।
কিন্তু সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বীজপুরে ভোটের দায়িত্ব শুভ্রাংশুকেই দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর দায়িত্ব পেয়েই অর্জুনের দিকে ঝুঁকে পড়া নেতা-কর্মীদের কড়া বার্তা দিতে শুরু করেন শুভ্রাংশু। যে কারণে হালিশহর ও কাঁচরাপাড়া পুরসভায় প্রার্থী ঘোষণার আগে থেকেই তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা দানা বাঁধতে থাকে। ছোটখাট মারপিট, বোমাবাজির ঘটনাও ঘটে। শেষমেশ কাঁচরাপাড়ায় ৫ জন এবং হালিশহরে ৯ জন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মূলত জোড়া পাতা চিহ্নে লড়ছেন তাঁরা।
দলের অন্দরের চোরাস্রোত সামাল দিতে তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। শুভ্রাংশু-অর্জুনের মধ্যে তাতে কতটা বরফ গলেছে, তা অবশ্য ভোটের ফলই বলবে। তবে আপাত ভাবে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা কিছুটা হলেও কমেছে। প্রচার চলাকালীন দু’পক্ষের মারপিটের তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি।
শুভ্রাংশুর মতে, ‘‘মানুষ উন্নয়ন দেখে ভোট দেবেন। গত চার-পাঁচ বারেও বামেরা এখানে যা করে দেখাতে পারেনি, আমরা মাত্র কয়েক বছর ক্ষমতায় থেকে তার অনেক গুণ বেশি কাজ করেছি। ভোট পেতে অসুবিধা হবে না।’’ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা নির্দল প্রার্থীরা তাঁর মাথাব্যথার কারণ নয়, এই দাবিও করছেন শুভ্রাংশু।
কী বলছেন অর্জুন সিংহ? ভাটপাড়ার বিধায়কের কথায়, ‘‘আমরা এককাট্টা ভাবে লড়ছি। কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই।’’
কিন্তু একদা সিপিএমের ‘গড়’ হালিশহর-কাঁচরাপাড়ায় (বীজপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত) বামেদের সেই দাপট কোথায় গেল? বস্তুত, এই দুই পুরসভায় সেই অর্থে বামেদের প্রচারই চোখে পড়ছে না। পোস্টার-ব্যানার ছেঁড়ার অভিযোগ কিছু হচ্ছে, কিছু কিছু হুমকির নালিশও জানাচ্ছেন বামেরা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সেই অর্থে রাস্তায় নেমে প্রচার বা সন্ত্রাসের বিরোধিতা করতে দেখা যাচ্ছে না বামেদের। এক সময়ে ব্যারাকপুরের সাংসদ তড়িৎ তোপদারের নামে যেখানে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত, সেখানে সব ওয়ার্ডে প্রার্থীই দিতে পারেনি সিপিএম। বীজপুর-ঘেঁষা গয়েশপুর পুরসভায় ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে তৃণমূল। হালিশহরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৬টি আসন দখল করে নিয়েছে তৃণমূল। কাঁচরাপাড়ায় ৭টি ওয়ার্ডেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে তারা।
অথচ, এই কাঁচরাপাড়া পুরসভার ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে গত পুরভোটে ১২টি পেয়েছিল বামেরা। তৃণমূলও পায় সমসংখ্যক আসন। টসে জিতে বোর্ড গড়েছিল ঘাসফুল শিবির।
বিজেপি-কংগ্রেস সে ভাবে প্রচারে জোরই দিতে পারেনি কাঁচরাপাড়া-হালিশহরে। গত শুক্রবার বিজেপির এ রাজ্যের নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ কাঁচরাপাড়ায় গিয়ে রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়েন কর্মীদের দিশাহারা অবস্থা দেখে। স্থানীয় ভূত বাগানে একটি মন্দির প্রাঙ্গণে বসে কর্মিসভা করতে হয়ে তাঁকে। প্রার্থীদেরও বাড়ি থেকে ডেকে আনতে হয়। হালিশহর, কাঁচরাপাড়া পুরসভার প্রার্থী ও কর্মীরা তাঁর কাছে অভিযোগ করেন, প্রচার করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে তাঁদের।
২০১০ সালের ভোটে হালিশহরে ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪টি ছিল বামেদের দখলে। ৮টিতে জয়ী হয় তৃণমূল। ১টি পেয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বামেদের সেই গড় তৃণমূলের প্রবল চাপে ভেঙে গিয়েছিল। ২০১৩ সালের শেষের দিকে সিপিএমের দুই কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেন। বেশ কয়েক জন সিপিএম কাউন্সিলর দীর্ঘ দিন বাড়ি ছাড়া ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আস্থা ভোট ডাকা হয়। সেখানে সিপিএম কাউন্সিলরদের অনেকে এবং খোদ চেয়ারম্যানই গরহাজির থাকায় তৃণমূল বোর্ড দখল করে।
সিপিএমের নৈহাটি-বীজপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রার্থীদের ভয় দেখিয়ে প্রচার করতে না দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাঁরা দখলদারি চালান, তাঁরা আগে সব ক’টি ওয়ার্ডে ভোট করার সুযোগ দিন, তারপর অন্য কথা।’’
বিজেপির জেলা সভাপতি অশোক দাস বলেন, ‘‘আমাদের প্রচার করতেই দেওয়া হচ্ছে না। প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে দলের সক্রিয় কর্মীদেরও। নির্বাচনী আধিকারিকের কাছে অভিযোগও জানিয়েছি।’’ সন্ত্রাস, হুমকির অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন শুভ্রাংশু। তাঁর মতে, ‘‘ওদের সংগঠনের জোরই নেই। প্রচার করবে কী করে?’’ আর অর্জুনবাবুর কটাক্ষ, ‘‘বিরোধীরা যেখানে প্রচার করতে পারছেন না, আমার কাছে আসুন। আমি তাঁদের প্রচারে সাহায্য করব!’’