যানজটে জেরবার হাবরা শহরের গতি ফেরানোর জন্য যখন প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সবুজ সঙ্কেত মিলেছে, জমি জরিপের কাজ শেষও হয়েছে। ইতিমধ্যে শহরেরই কিছু ব্যবসায়ীর নানা প্রশ্নে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে হাবরায়।
প্রস্তাবিত দু’টি উড়ালপুলের ক্ষেত্রে পুনর্বাসন নিয়ে ক্ষোভ জমেছে ওই ব্যবসায়ী মহলে। সোমবার সন্ধ্যায় তাঁরা কিছুক্ষণের জন্য দোকানের আলো বন্ধ রেখে প্রতীকি প্রতিবাদে সামিল হন। তাঁদের বক্তব্য, কী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হচ্ছে না প্রশাসনের তরফে। তার বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন সকলে।
উড়ালপুল তৈরির কাজ যাতে মসৃণ ভাবে এগোয়, সে জন্য ক’দিন আগেই সরেজমিনে আসেন জেলাশাসক অন্তরা আচার্য ও পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশও চাইছেন, যশোর রোডকে যানজট মুক্ত করার অঙ্গ হিসাবে দু’টি আরওবি (রেলওয়ে ওভারব্রিজ) দ্রুত তৈরি হোক। সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে সম্প্রতি। হাবরা পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, সংখ্যাটা প্রায় সাড়ে সাতশো। যদিও এঁদের বেশিরভাগই সরকারি জায়গা জবরদখল করে দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবসা করছেন। ওই সব দোকনদারকে কী ভাবে পুনর্বাসন দেওয়া যায়, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও পুরপ্রধান নীলিমেশ দাস বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রস্তাবিত উড়ালপুল দু’টির জন্য যশোর রোডের দু’পাশে ৩০ মিটার করে জমি প্রয়োজন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ এ জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ দেবে না। রাজ্য সরকার পুরসভার মাধ্যমে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কথা ভাবছে। জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘হাবরার মানুষের বহু দিনের দাবি, যানজট সমস্যা কমাতে শহরে উড়ালপুল তৈরি হোক। এলাকার উন্নয়নের জন্য আমরা তা তৈরি করবই। প্রয়োজনে জনমত তৈরি করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে পুনর্বাসনও দেওয়া হবে।’’ জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ যাতে সকলের সহমতে দ্রুত এগোয়, সে জন্য সব পক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু।
সমস্যা মেটাতে ইতিমধ্যেই পুরসভার পক্ষ থেকে শপিং মলের আদলে চারটি মার্কেট তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেখানে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে। পুরসভা সূত্রে জানানো হয়েছে, ২ নম্বর রেলগেটের কাছে বিদ্যুৎ দফতরের ৪১ কাঠা জমির উপরে একটি, পুরভবনে ঢোকার গলির কাছে ২১ কাঠা জমির উপরে একটি, রাজা মার্কেটের কাছে অতুলচন্দ্র সরণী এলাকায় ২৬ কাঠা জমির উপরে একটি এবং জয়গাছি সুপার মার্কেটে একটি— মোট চারটি মার্কেট তৈরি করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ দফতরের জমি যাতে পাওয়া যায়, সে জন্য জেলাশাসক ১৫ সেপ্টম্বর রাজ্যের মুখ্য সচিবের সঙ্গে আলোচনা করবেন। যত দিন না ওই মার্কেট তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সেখানে পুনর্বাসন দেওয়া হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত বিকল্প একটি জমি চিহ্নিত করে সেখানে অস্থায়ী দোকান ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে। নিলীমেশবাবু বলেন, ‘‘ছ’মাসের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ দোকানদারদের নতুন মার্কেটের নীচের তলায় পুনর্বাসন দেওয়া হবে। এক বছরের মধ্যে সকলকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে।’’ ওই মার্কেটগুলিতে লিফ্ট-সহ নানা আধুনিক সুবিধা থাকবে বলেও জানান তিনি। পুরপ্রধানের কথায়, ‘‘মার্কেটগুলির উপরের তলায় কলকাতার নামীদামি সংস্থাকে নিয়ে আসা হবে ব্যবসা করার জন্য। এর ফলে দূরদূরান্তের বহু মানুষ হাবরায় কেনাকাটা করতে আসবেন। আখেরে এখানকার ব্যবসায়ীরাও তাতে উপকৃত হবেন।’’
কিন্তু ব্যবসায়ীদের সকলে পুরসভার ওই উদ্যোগের কথা হয় জানেন না বা জেনেও বিরোধিতা করছেন বলে ব্যবসায়ী মহলেরই একাংশের অভিযোগ। হাবরা চেম্বার্স অব কমার্সের সম্পাদক নিরঞ্জন সাহা জানিয়েছেন, স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। ফলে কিছু ব্যবসায়ীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আমরা চাই, উড়ালপুল তৈরি হোক। সমস্যা মেটাতে আমরা বৃহস্পতিবার সংগঠনের সাধারণ সভা ডেকেছি। সেখানে আলোচনা করে সমস্যা মেটাতে হবে।’’
এর আগে বহুবার যশোর রোড সম্প্রসারণ, উড়ালপুল তৈরির কথা হয়েছে হাবরায়। রাজনৈতিক দলগুলির থেকে বহু প্রতিশ্রুতি মিলেছে। কিন্তু কাজ কিছুই এগোয়নি। নানা জটিলতায় বার বার আটকে গিয়েছে উদ্যোগ। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে যশোর রোড সম্প্রসারণের কাজে হাত দিয়েছে প্রশাসন। দিন কয়েক আগে জেলাশাসকের দফতরে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। তারপরেই কাজে গতি এসেছে। ইতিমধ্যে জরিপের কাজ শুরুও হয়েছে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, হাবরা শহরে যশোর রোডের উপরে বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখায় দু’টি রেলগেট আছে। হাবরা শহরের তীব্র যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ, ওই রেলগেট দু’টি। রেলগেটের কারণে যানের গতি এখানে থমকে গিয়েছে। বারাসত থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার যশোর রোড সম্প্রসারণের অঙ্গ হিসাবে হাবরায় দু’টি উড়ালপুল তৈরির কাজ শুরু করেছে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। দু’টি উড়ালপুল হবে প্রায় ২৪০০ মিটার দীর্ঘ। একটি হবে, স্থানীয় বিটি কলেজ মোড় থেকে ২ নম্বর রেলগেট পেরিয়ে দেশবন্ধু পার্কের সামনে পর্যন্ত। অন্যটি তার ১০০ মিটার পর থেকে শুরু হয়ে ১ নম্বর রেলগেট পেরিয়ে শেষ হবে পোস্ট অফিস মোড়ের কাছে। এ জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা। উড়ালপুল দু’টি ১৪ মিটার করে চওড়া হবে। তার নীচ দিয়ে ১১ মিটার চওড়া রাস্তা থাকবে। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, মূলত রাস্তার পাশে সে সব সরকারি জায়গা জবরদখল করে রাখা হয়েছে, তা এখন চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রয়োজনে কিছু জমি অধিগ্রহণও করা হতে পারে।