পাশে থেকেছেন এঁরাই।ইনসেটে, চিকিৎসাধীন বৃদ্ধা।
কেউ বলছে, ‘মনে হয় মরে গিয়েছে।’ কেউ শুধু ‘আহা রে’ বলেই দায়িত্ব সারছে। একজন ঝুঁকে পড়ে গায়ে হাত দিতে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে শুভানুধ্যায়ীরা বলে উঠল, ‘আরে ছোঁবেন না ছোঁবেন না, পুলিশ কেসে ফাঁসতে হবে!’
যাঁকে ঘিরে এমন মন্তব্যের ভিড়, সেই বৃদ্ধা তখন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রাস্তার ধারে। বৃহস্পতিবার সকাল সা়ড়ে ১০টা নাগাদ, বেতবেড়িয়া স্টেশন থেকে খানিক দূরে।
দৃশ্যটা চোখে পড়ে দুই কলেজ পড়ুয়ার। তাঁদেরই একজন বৃদ্ধার হাতের নাড়ি পরীক্ষা করেন। বোঝেন, তখনও প্রাণ আছে। নাকের সামনে হাত নিয়ে গিয়ে দেখেন, সামান্য হলেও শ্বাস পড়ছে।
বিল্টু লস্কর আর মুজিবর মণ্ডল নামে ঘুটিয়ারিশরিফের বাসিন্দা দুই সদ্য তরুণ বুঝে নেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে হয় তো প্রাণে বাঁচানো যাবে বৃদ্ধাকে। ভিড়ের দিকে মুখ তুলে তাঁরা বলেন, ‘‘একটা গাড়ি-টাড়ি ডাকুন না, হাসপাতালে নিয়ে যাই।’’ নিমেষে ভিড়টা আকাশ-বাতাস-গাছপালার দিকে নজর সরায়। পাতলাও হতে থাকে আস্তে আস্তে।
বিল্টু-মুজিবররা বুঝে নেন, যা করতে হবে তাঁদেরকেই করতে হবে।
ক’দিন আগেই দিল্লির রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ পড়েছিলেন রক্তাক্ত এক যুবক। বহু লোক দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এক রিকশাওয়ালা জখম যুবকের মোবাইল ফোনটা পকেট থেকে সরিয়ে ফেলে। এ সবেরই বিপরীতে বৃহস্পতিবার এক অন্য দৃশ্যের সাক্ষী থাকল বেতবেড়িয়া।
শেষমেষ দুই ছাত্রই বৃদ্ধাকে নিয়ে যান ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালে। হাসপাতালের সুপার অর্ঘ্য চৌধুরী বলেন, ‘‘ওঁর শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। মাথায় গভীর ক্ষত আছে। তবে হাসপাতালে আনায় সব রকম চেষ্টা শুরু হয়েছে।’’ পুলিশ জানিয়েছে, বৃদ্ধার পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। অন্য থানাগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কী ভাবে চোট পেলেন বৃদ্ধা, তা-ও জানার চেষ্টা হচ্ছে।
মানুষের ব্যবহারে যারপরনাই বিস্মিত বারুইপুর সুশীল কর কলেজের প্রথম বর্ষ ছাত্র দুই যুবক। যে ভাবে সকলে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন জখম বৃদ্ধাকে দেখেও, তা হজম করতে পারছেন না সদ্য তরুণেরা। বললেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত উনি কতটা সুস্থ হবেন জানি না, তবে আমাদের কর্তব্য করতে পেরে আমরা খুশি।’’
কী ভাবে হাসপাতালে পর্যন্ত তাঁরা নিয়ে গেলেন বৃদ্ধাকে, তাতেও অনেক নাটক।
দুই বন্ধুই বৃদ্ধাকে পাঁজাকোলা করে যান পাশেই এক হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। ওই চিকিৎসক পরামর্শ দেন, এখানে তাঁর বিশেষ কিছু করার নেই। বরং এখনই যদি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়, তা হলে হয় তো প্রাণটা বাঁচতে পারে।
কিন্তু এ বার দরকার ছিল একটা গাড়ির। আশপাশের লোকজন গা়ড়ি জোগাড় করেও সাহায্য করেননি বলে আক্ষেপ দুই যুবকের। নিজেরাই জোগাড় করেন একটা ইঞ্জিন ভ্যান। মুজিবররা জানান, চালক কিছুতেই টাকা নিতে চাইছিলেন না। এক রকম জোর করেই তাঁর হাতে ৪০টা টাকা ধরিয়ে দিয়েছেন মুজিবররা।
শুধু হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে এসেই কর্তব্য সারেননি দুই যুবক। সারা দিন সেখানেই পড়ে থেকে বৃদ্ধাকে নিয়ে মাথার সিটি স্ক্যান-সহ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ে হাজির থেকেছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, যাওয়ার সময়ে তাঁরা জানিয়ে গিয়েছেন, এখন কাছে টাকা তেমন নেই। পরে আবার আসবেন। টাকার দরকার হলে সেই সাহায্যও করবেন।