প্রস্তুতি: ক্লাসঘর পরিষ্কার করা হচ্ছে। অশোকনগরের একটি স্কুলে। ছবি: সুজিত দুয়ারি।
দাদা-দিদিরা তো যাচ্ছে, আমরা স্কুলে যাব কবে— এ প্রশ্ন কিছুদিন ধরেই বিব্রত করছিল বাবা-মায়েদের। বিভিন্ন মহল থেকে রাজ্য সরকারের উপরে চাপ আসছিল, সব ক্লাসের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করার জন্য। বহু রাজ্য ইতিমধ্যে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় চাপ বেড়েছিল। স্কুলে না গেলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, মানসিক স্বাস্থ্যের হাল যে ক্রমশ তলানিতে গিয়ে ঠেকছে, সে কথা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। পাড়ায় ক্লাস চালাতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল স্কুলগুলিকে। ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে স্বস্তিতে থাকছিলেন না বাবা-মায়েরাও।
অবশেষে আজ, বুধবার থেকে প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিকের ছেলেমেয়েদের জন্যও খুলছে ক্লাসরুমের দরজা। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পঠনপাঠন শুরু হয়েছে আগেই।
মঙ্গলবার সকাল থেকে দুই জেলার বেশিরভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতির কাজে নেমে পড়েছেন। তবে বেহাল পরিকাঠামো নিয়ে চিন্তিত বহু স্কুল। পড়ুয়াদের স্কুলে আসা নিশ্চিত করতে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চলছে। পঞ্চায়েত সদস্যদের দিয়ে অভিভাবকদের জানানো হয়েছে কোনও কোনও এলাকায়।
অশোনগরের আদর্শ জুনিয়র বেসিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক শঙ্করকুমার মিস্ত্রি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে শ্রেণিঘর পরিষ্কার করেছেন। শঙ্কর বলেন, ‘‘প্রায় দু’বছর পর স্কুল খুলছে। পড়ুয়ারা ক্লাসরুমের চেনা পরিবেশে ফিরবে। আনন্দ করবে। এটা ভেবেই ভাল লাগছে।’’
বনগাঁ হাইস্কুল (প্রাথমিক) সূত্রে জানানো হয়েছে, প্রাক প্রাথমিক থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়ার সংখ্যা ৯৬০ জন। প্রধান শিক্ষক বিদ্যুৎকুমার মণ্ডল বলেন, ‘‘সব ক’টি শ্রেণির পঠনপাঠন এক সঙ্গে চালু করতে হলে পড়ুয়াদের শারীরিক দূরত্ববিধি বজায় রেখে ক্লাস করানো সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমে (রোটেশনাল পদ্ধতি) ক্লাস চালু করলে করোনা বিধি বজায় থাকবে। কী ভাবে পঠনপাঠন চালানো হবে, তা জানতে শিক্ষা দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’’
বসিরহাটের মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, হাড়োয়া, বাদুড়িয়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় মঙ্গলবার স্কুলগুলি জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে। বেশ কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে শৌচালয়গুলি বেহাল। এ দিন তা ব্যবহারযোগ্য করে তোলার কাজ শুরু হয় অনেক স্কুলেই। পাশাপাশি মিড-ডে মিলের রান্নাঘর, খাওয়ার ঘরগুলি পরিষ্কার করে ব্যবহারের উপযুক্ত করা হয়েছে।
করঞ্জতলা সুভাষিনী বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক এক্সরাক আলি মোল্লা বলেন, ‘‘শিক্ষা দফতরের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা স্কুলের ঘরগুলি পরিষ্কার করেছি। বৈদ্যুতিক সংযোগ ঠিক আছে কি না, তা-ও পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।’’ সন্দেশখালি ১ বিডিও সুপ্রতিম আচার্য বলেন, ‘‘সরকারি নির্দেশ মেনে ব্লকের প্রতিটা স্কুল জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে। পড়ুয়াদের বিদ্যালয়মুখী করে তোলার জন্য পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।’’
রান্নাঘর বেহাল হওয়ায় মিড ডে মিল রান্না করা নিয়ে সমস্যার কথা জানালেন হিঙ্গলগঞ্জ থানার নবীনগঞ্জ জুনিয়র হাইস্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুল সূত্রে খবর, স্কুলের পাশেই রয়েছে নবীনগঞ্জ এফপি স্কুল। এই দু’টি স্কুলের মিড ডে মিল রান্না হত নবীনগঞ্জ এফপি স্কুলের রান্নাঘর থেকেই। কিন্তু রান্নাঘরটি প্রায় দু’বছর ধরে বেহাল। পাড়ায় শিক্ষালয় চালু হওয়ার পরে রাঁধুনিরা বাড়ি থেকে রান্না করে এনে পড়ুয়াদের খাওয়াচ্ছেন। রান্নার খরচ বহন করছে স্কুল। নবীনগঞ্জ জুনিয়র স্কুলের শিক্ষক বিকাশইন্দু সরকার বলেন, ‘‘ছাদ মেরামতির জন্য ৫০ হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছে। তবে কাজ করা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। ফলে বিপজ্জনক রান্নাঘরটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।’’
হিঙ্গলগঞ্জ থানার পশ্চিম পুকুরিয়া ভবানী এফপি স্কুল সূত্রের খবর, স্কুলের রান্নাঘরের ছাদ আমপানের পরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন সেখানে রান্না করা যায় না। স্কুলের বারান্দার একটা অংশ ঘিরে নিয়ে সেখানেই রান্না করতে হচ্ছে। প্রায় একই অবস্থা হিঙ্গলগঞ্জ স্বরূপকাঠি এফপি স্কুলেরও রান্নাঘরের। এই স্কুলের ক্লাসঘরগুলিও বেহাল। পড়ুয়াদের বসাতে সমস্যায় পড়তে হবে বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক। হিঙ্গলগঞ্জ সার্কেল স্কুল পরিদর্শক মহম্মদ নিজামউদ্দিন বলেন, ‘‘বেশিরভাগ স্কুলেই কোনও সমস্যা নেই। দু’একটি স্কুলের যা সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।’’ মঙ্গলবার সকাল থেকেই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, প্রাথমিক স্কুল, হাইস্কুলগুলি ঘুরে দেখেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন ব্লক প্রশাসনের আধিকারিকেরা। ক্যানিং ১ বিডিও শুভঙ্কর দাস ও ব্লক প্রশাসনের অন্যান্য আধিকারিকেরা গোটা ব্লকের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে স্কুল পরিদর্শন করেন। প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকলেও বিধানসভা ভোটের কারণে অনেক স্কুলেই ভোটের বুথ তৈরি হয়েছিল। সেই স্কুলগুলির পরিকাঠামো আগেই ঠিক করা হয়েছে বলে দাবি প্রশাসনের। তবে দু’একটি স্কুলে কিছু পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে বলে জানান তাঁরা। সেই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হবে বলেও জানিয়েছেন বিডিও।
বাসন্তী ও গোসাবা ব্লকের স্কুলগুলিও প্রশাসনের তরফে পরিদর্শন করা হয়। ডায়মন্ড হারবার মহকুমা এলাকায় সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছে স্কুলগুলি। বিদ্যালয়ের বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার স্যানিটাইজ় করা হয়েছে। এক শিক্ষকের আক্ষেপ, ২৪ ঘণ্টার নোটিসে স্কুল খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্কুল পরিষ্কার করার জন্য পঞ্চায়েত বা ব্লক প্রশাসন সহযোগিতা করেনি। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলের পরিকাঠামোর সংস্কার দরকার। বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, জানলা, দরজা ভেঙে রয়েছে। গত বছর অগস্ট মাসে স্কুল ভবনের ক্ষতি সংক্রান্ত রিপোর্ট তলব করেছিল শিক্ষা দফতর। আমরা সমস্ত নথি ছবি-সহ পাঠিয়েছিলাম। শুনেছি টাকা অনুমোদন হয়েছে। কিন্তু আমরা কেউ হাতে টাকা পাইনি।’’
সাগর ব্লক প্রশাসন সূত্রে খবর, প্রতিটি প্রাইমারি স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু হয়েছে। সব স্কুলে ব্লিচিং পাউডার, বালতি, স্যানিটাইজ়ার পাঠানো হয়েছে। একই চিত্র কাকদ্বীপ মহকুমার প্রতিটি ব্লকেও। চৌরঙ্গী অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা ক্লাস শুরু করতে প্রস্তুত। মিড ডে মিলের সরঞ্জাম, চেয়ার-টেবিল পরিষ্কার করা হয়েছে।’’