ফাঁকা খামার। বনগাঁয়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
দাম পড়তে পড়তে তলানিতে। কেজি ২৫ টাকা!
এমনই হাল বাদুড়িয়ার মুরগির ব্যবসায়। ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। তবে যাঁরা করোনাভাইরাসের আতঙ্ককে পাত্তা দিচ্ছেন না, তাঁদের ফুর্তি দেদার। সস্তায় মুরগি উঠছে পাতে। বিশেষজ্ঞেরাও অবশ্য বলছেন, পোলট্রির মুরগির সঙ্গে করোনাভাইরাসের কোনও সম্পর্ক এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অযথা আতঙ্কিত হবে না। কিন্তু সে বার্তা লোকের কানে উঠলে তো! কাজেই আপাতত মুরগির দাম কমিয়ে কোনও মতে বিক্রি করে দিতে পারলেই বাঁচেন ব্যবসায়ী। কারণ, ব্যবসা কার্যত তলানিতে।
ক’দিন আগেও বাদুড়িয়ায় মুরগির কাটা মাংসের দাম ছিল ১৮০ টাকা কেজি। সেই মুরগিই এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা কেজি দরে। তা-ও নাকি কেনার লোক পাওয়া যাচ্ছে না।!
মঙ্গলবার বাদুড়িয়া চৌমাথা দিয়ে যেতে যেতে শোনা গেল, কয়েকজন পুরুষ-মহিলা মুরগি হাতে হাঁকাহাঁকি করছেন। ‘একটা পঁচিশ, দু’টো পঞ্চাশ’— সেই হাঁকডাকে লোকে দাঁড়িয়ে পড়ে শুনছে, টিপন্নি কাটছে বটে, কিন্তু কিনতে তেমন এগিয়ে আসছেন না। ফতেমা বিবি নামে এক বিক্রেতা বলেন, ‘‘মাংসের দাম মিলছে না বলে মুরগির খাবারও আসাও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় খরচ করে মুরগি পোষার থেকে যে দাম পাই, তাতেই বিক্রি করে দিচ্ছি।’’ ফজের আলি, স্বপন মণ্ডলরা জানালেন, আগে ছুটির দিনে বাজারে বসে কম পক্ষে ৫০-৬০ কিলো মুরগির মাংস বিক্রি হত। বর্তমানে ৫-১০ কেজির বেশি বিক্রি হচ্ছে না। কোনও কোনও ব্যবসায়ী মুরগি কাটাই ছেড়ে দিয়েছেন। অনুষ্ঠান বাড়িতেও এখন আর কেউ মুরগি খেতে চাইছেন না। এই পরিস্থিতিতে মাছ আর খাসির মাংসের দর বাড়ছে। খাসির মাংস কোথাও কোথাও ৭০০-৭৫০ টাকা কেজি দর হাঁকছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্লক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বসিরহাট মহকুমায় সব থেকে বেশি মুরগির খামার বাদুড়িয়ায়। কয়েক হাজার পোলট্রি আছে। কলকাতার বাজারে নিয়ে যায় এখানকার মুরগি। মুরগি ব্যবসায়ীদের দাবি, কলকাতা শহরে মুরগির মাংসের দাম কিছুটা কমলেও গ্রাম অথবা শহরতলিতে হু হু করে দাম পড়ছে।
পরিস্থিতি খারাপ বনগাঁতেও। কোথাও কোথাও পোলট্রি শূন্য। একটিও মুরগি নেই। কোথাও পড়ে আছে হাতেগোনা কয়েকটি।
বনগাঁর রামকৃষ্ণপল্লি এলাকার বাসিন্দা পিনাকী দাসের বাড়িতে পোলট্রি আছে। করোনাভাইরাস নিয়ে গুজবের জেরে তিনি খামারের সব মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন। পিনাকীর কথায়, ‘‘১১২৫টি মুগরি ছিল। করোনা-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার আগে কেজি প্রতি মুরগির পাইকারি মূল্য ছিল ৮০-৮৫ টাকা। এখন যে দামে বিক্রি করলাম, তাতে ২২-২৪ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে।’’
নূতনগ্রাম খড়েরমাঠ এলাকায় খামার আছে কালীপদ সরকারের। একটি সংস্থা তাঁর খামার থেকে মুরগি নিয়ে যায়। কালীপদ জানান, জানুয়ারি মাসে খামার থেকে ১৭০০ মুগরি বিক্রি করেছিলে। লাভ হয়েছিল ২৪ হাজার টাকা। এখন ১৪০০ মুরগি নিয়ে গিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু কত দাম পাবেন, তা নিয়ে সংশয়ে কালীপদ। নূতনগ্রাম পোস্ট অফিসপাড়ার মুরগি ব্যবসায়ী সুদেব বিশ্বাস বলেন, ‘‘গুজবেই ব্যবসা শেষ হতে বসল।’’
বনগাঁর বাজারগুলিতে কেজি প্রতি কাটা মাংস বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকায়। তবুও মানুষ কিনছেন না। বনগাঁর বিএসএফ ক্যাম্প মোড় এলাকায় দেখা গেল, মাইক লাগিয়ে চোঙা ফুঁকে ক্রেতাদের ডাকাডাকি করছেন বিক্রেতারা।
চিকিৎসকেরা অবশ্য অভয় দিচ্ছেন নির্ভয়ে মুগরির মাংস খাওয়ার। করোনাভাইরাসের সঙ্গে মুগরির মাংসের কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানাচ্ছেন। বনগাঁ শহরের চিকিৎসক, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বনগাঁ শাখার সম্পাদক আশিসকান্তি হীরা বলেন, ‘‘করোনাভাইরাস ছড়ায় ড্রপলেট ইনফেকশন (কফ, থুতু, লালা) থেকে। মুরগির মাংস থেকে কোনও ভাবেই সংক্রমণ ছড়ায় না। এটা সম্পূর্ণ গুজব।’’
ডায়মন্ড হারবার মহকুমাতেও ব্রয়লার মুরগির ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড়। ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, আগেও বার্ড ফ্লুয়ের সময়ে ব্যবসাযর এতটা ক্ষতি হয়নি।
সরিষা আশ্রম মোড়ের মুরগি ব্যবসায়ী মহেন্দ্র মণ্ডল জানালেন, বিয়ে বাড়ির মরসুমে ব্যবসার হাল খারাপ। গোটা মুরগি ৫০-৬০ টাকায় বিকোচ্ছে। যেখানে দাম হওয়ার কথা ১৪০-১৫০ টাকা। প্রতি রবিবার দোকানে বিক্রি ছিল প্রায় এক কুইন্টাল। সেখানে বিক্রি ঠেকেছে ২০-৩০ কেজিতে।
এক ব্যবসায়ী জানালেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসের গুজব ঠেকাতে ক’দিন আগে শহরে মাইকে প্রচার হয়েছিল। কিন্তু তাতে খুব বেশি সচেতন হননি মানুষ।
ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যক্ষ রমাপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘মুরগির মাংসের সঙ্গে ওই রোগের কোনও সম্পর্ক নেই। মানুষ অকারণ ভয় পাচ্ছেন।’’ মহকুমাশাসক সুকান্ত সাহা জানান, এ নিয়ে আরও প্রচার চালানো হবে।