জোড়াতালি: এখানেই মাথা গুঁজে থাকেন দেবানন্দ মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র
পাঁচ জনের সংসার দেবানন্দ মণ্ডলের। বনগাঁ ব্লকের ছয়ঘড়িয়া পঞ্চায়েত এলাকার হরিদাসপুর পাড়ুইপাড়ায় থাকেন টিন দিয়ে ঘেরা এক চিলতে ঘরে। দেবানন্দ ও তাঁর ছেলে অজয় চিরুনি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন। হার্টের অসুখে ভুগছেন গৃহকর্তা। আপাতত হাসপাতালে।
আবাস যোজনার সংশোধিত তালিকায় দেবানন্দের নাম আছে। তাঁর বৌমা কল্যাণী বলেন, ‘‘আমার সাত বছরের একটি মেয়ে। ঝড়বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে সাপ ঢুকে পড়ে। প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকি। ভেবেছিলাম, পাকাবাড়ি পেলে নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। সে আর হচ্ছে কই!’’
কুমার মণ্ডল বছরখানেক আগে মারা গিয়েছেন। সংশোধিত পাকাবাড়ি পাওয়ার তালিকায় তাঁর নাম আছে। পরিবারে এখন আছেন তাঁর স্ত্রী রঞ্জিতা এবং দুই ছেলে। টালি ও বেড়ার ভাঙাচোরা ঘর। কিছুটা অংশ ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। সামান্য একটু জমিতে চাষবাস করেন ছেলে সমর।
তিনি বলেন, ‘‘ঝড়ে এক বার ঘর ভেঙে পড়েছিল। অল্পের জন্য বাবা চাপা পড়েননি সে বার। ঝড় উঠলে জেঠুর পাকাবাড়িতে আশ্রয় নিই। ঘরে যখন তখন সাপ, ছুঁচো ঢোকে। বৃষ্টি হলে ঘর জলে ভেসে যায়।’’
পাকাবাড়ির তালিকায় নাম থাকায় আশায় বুক বেঁধেছিলেন রঞ্জিতা। কিন্তু এখনও ঘরের টাকা না পাওয়ায় হতাশ। বললেন, ‘‘খুবই অসুবিধার মধ্যে আছি। সামর্থ্য থাকলে নিজেরাই পাকাবাড়ি করে নিতাম।’’ তাঁর কথায়, ‘‘টাকাই এল না এখনও, এত তদন্ত করে তা হলে কী লাভ হল!’’
আবাস যোজনার তালিকায় নাম ওঠার পরেও এত দিনে টাকা না পেয়ে হতাশ অনেকেই। অনেকে আবার নতুন বাড়ি পাবেন, এই আশায় পুরনো ঘর ভাঙতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা ভাঙাবাড়ি নতুন করে মেরামত করেছেন। অনেকেরই প্রশ্ন, কয়েক দফায় বাড়িতে এসে তদন্ত হল। প্রশাসনের লোকজন আশ্বাস দিলেন, দ্রুত টাকা পাওয়া যাবে। কার সাথে কার কীসের ঝামেলা জানি না। রাজনীতি বুঝি না। নিজেদের ভাঙা ঘরে আর থাকা যাচ্ছে না—তা বিলক্ষণ টের পাচ্ছি।
প্রশাসনের কর্তারাও মনে করছেন, তালিকায় গোলমাল থাকলে তদন্ত চলুক। কিন্তু গরিব মানুষের টাকা দেওয়ার কাজ দ্রুত শুরু করে দেওয়া উচিত। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৮ সালের তালিকার এক তৃতীয়াংশ নামই বাদ গিয়েছে আবাস প্লাসের নতুন সংশোধিত তালিকায়। প্রাথমিক পর্যায়ে জেলায় ৫৫ হাজার মানুষের নামে ঘরের অনুমোদনও এসেছে। এঁদের পাকাবাড়ি তৈরির জন্য প্রথম কিস্তিতে ৬০ হাজার টাকা করে পাওয়ার কথা ছিল।
প্রশাসন সূত্রের খবর, আবাস যোজনার পুরনো তালিকায় নাম ছিল ২ লক্ষ ৮৭ হাজার মানুষের। সাম্প্রতিক ঝাড়াই-বাছাইয়ের পরে চূড়ান্ত তালিকায় নাম আছে ১ লক্ষ ৮৯ হাজার মানুষের। বাদ গিয়েছে ৯৮ হাজার মানুষের নাম।
টাকা না পাওয়ায় ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে মানুষের মধ্যে। পঞ্চায়েত প্রধান ও জনপ্রতিনিধিরা প্রশ্নের মুখে পড়ছেন।
ছয়ঘড়িয়া পঞ্চায়েতের প্রধান প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘আবাস যোজনার সংশোধিত তালিকায় এই পঞ্চায়েতের ৩২৬ জনের নাম আছে। টাকা পাওয়ার আশায় অনেকেই ঘর ভাঙতে শুরু করেছিলেন। এখন অনেকেই খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন। এত টালবাহানা কেন হবে?’’ গঙ্গানন্দপুর পঞ্চায়েতের প্রধান জাফর আলি মণ্ডল বলেন, ‘‘সংশোধিত তালিকায় এই পঞ্চায়েতে ২১১ জনের নাম আছে। বলা হয়েছিল, তালিকা প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে পাকাবাড়ি তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। এখন সকলেই হতাশ!’’ বৈরামপুর পঞ্চায়েতের প্রধান তনুজা খাতুন মোল্লার কথায়, ‘‘কেন্দ্র তদন্ত করাল। তারপরেও টাকা দেওয়া হচ্ছে না কেন? গরিব মানুষদের প্রাপ্য দ্রুত মেটানো হোক।’’