অপহৃত ৩ মৎস্যজীবী, মুক্তিপণ চায় জলদস্যুরা

বার বার কেটে যাচ্ছিল ফোনের লাইন। আর যত বার কথা হচ্ছিল, এ প্রান্ত থেকে ভেসে যাচ্ছিল টুকরো টুকরো কথা। ‘‘ভাইজান, ওদের প্রাণে মারবেন না। আমরা দেখছি কী করা যায়।’’ কখনও বলা হচ্ছিল, ‘‘গরিব মানুষ দাদা, একটু বোঝার চেষ্টা করুন।’’ কখনও কাতর আবেদন, ‘‘আমরা দেখছি টাকাটা কী ভাবে জোগাড় করা যায়। দয়া করে ওদের মারধর করবেন না।’’

Advertisement

সামসুল হুদা

ক্যানিং শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৫৬
Share:

বাড়ি ফিরতে পারলেও মারধরে জখম। —নিজস্ব চিত্র।

বার বার কেটে যাচ্ছিল ফোনের লাইন।

Advertisement

আর যত বার কথা হচ্ছিল, এ প্রান্ত থেকে ভেসে যাচ্ছিল টুকরো টুকরো কথা। ‘‘ভাইজান, ওদের প্রাণে মারবেন না। আমরা দেখছি কী করা যায়।’’ কখনও বলা হচ্ছিল, ‘‘গরিব মানুষ দাদা, একটু বোঝার চেষ্টা করুন।’’ কখনও কাতর আবেদন, ‘‘আমরা দেখছি টাকাটা কী ভাবে জোগাড় করা যায়। দয়া করে ওদের মারধর করবেন না।’’

ফোনের ও প্রান্ত থেকে কখনও শোনা যাচ্ছিল হুমকি, কখনও গালি, কখনও দরাদরির প্রস্তাব।

Advertisement

সব মিলিয়ে শুক্রবারও বাংলাদেশি জলদস্যুদের হাতে অপহৃত ৩ মৎস্যজীবীর খোঁজ মেলেনি। আতঙ্কিত পরিবারগুলি পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানোরও সাহস করেনি। তবে বিভিন্ন সূত্রে পুলিশ ইতিমধ্যেই জেনেছে পুরো বিষয়টি। বিএসএফের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে তারা। পরিস্থিতির উপরে নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশের এক কর্তা।

গত ৩১ মার্চ জীবনতলার মৌখালি থেকে ‘মা মনসা’ এবং ‘মা ফতেমা’ ট্রলার দু’টিতে ২১ জন মৎস্যজীবী গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। ভাসতে ভাসতে তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ-লাগোয়া বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি চাঁদখালিতে। প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল জলদস্যুদের হামলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।

মা মনসা ট্রলারে ছিলেন ইউনুস মোল্লা, সামাদ মোল্লা, খালেক মোল্লারা। তাঁরা জানালেন, বুধবার তখন বেলা দেড়টা। মা মনসা ও মা ফতেমা ট্রলার দু’টি নোঙর করে জাল ফেলে সকলে দুপুরের খাওয়া সেরে নিচ্ছিলেন। আবহাওয়া ভালই ছিল। ক’দিন কাজ করে ঢের মাছও উঠেছিল। সকলেরই মেজাজ শরিফ। চোখে পড়ে, ঝড়খালির অন্য একটি ট্রলার তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামাসরা ধরে নেন, সকলে এক সঙ্গে খাবেন বলে ওই ট্রলারের সাত জন মৎস্যজীবী আসছেন কাছাকাছি।

তখনও কেউ জানেন না, কী ঘটনা অপেক্ষা করে আছে। ঝড়খালির ট্রলারটি মা মনসার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। হঠাৎই সেখান থেকে রিভলবার, পাইপগান গানে নেমে আসে ১০-১২ জন জলদস্যু। তাদের সঙ্গে একটি ভুটভুটিও ছিল বলে জানিয়েছেন এই মৎস্যজীবীরা।

মা মনসায় উঠেই শুরু হয় মারধর। ইউনুসদের মুখের ভাত তখন গলায় আটকে যাওয়ার দশা। যাকে হাতের সামনে পেয়েছে, তাদেরই জলদস্যুরা এলোপাথাড়ি পেটাতে শুরু করে। বন্দুকের বাঁটের ঘায়ে মাথা ফাটে খালেক মোল্লার। কেউ কেউ ভয়ে জলে লাফ দেন।

মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, তিনটি ট্রলারকে চাঁদখালির জঙ্গলের কাছাকাছি নিয়ে যায় জলদস্যুরা। সেখানে গিয়ে আর একপ্রস্ত মারধর চলে। তিনটি ট্রলার থেকে প্রায় তিন লক্ষ টাকার মাছ নিজেদের ভুটভুটিতে তুলে নেয় দুষ্কৃতীরা। এরপরে তিনটি ট্রলার থেকে বেছে তিন জনকে ভুটভুটিতে তুলে নেয় তারা। ওই তিন জন হলেন, সামাদ মোল্লা, মুছা মোল্লা, বাপ্পা রপ্তান। ইউনুস বলেন, ‘‘ওরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কান্নাকাটি করছিল। হাতে-পায়ে ধরছিল জলদস্যুদের। কিন্তু কোনও কথায় কোনও কান দেয়নি দুষ্কৃতীরা। মারতে মারতে ভুটভুটিতে তুলে নেয় তিন জনকে।’’

ইউনুসরা জানালেন, যাওয়ার আগে একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। বলা হয়, তিন জনের জন্য মাথা-পিছু ১ লক্ষ টাকা করে মোট ৩ লক্ষ টাকা দিতে হবে। তা হলেই ছাড়া হবে ওই তিন জনকে। না হলে মেরে ফেলে দেওয়া হবে জলে। থানা-পুলিশ করলেও ফল ভাল হবে না বলে জানিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। ওই নম্বরে ফোন করে কবে কোথায় মুক্তিপণের টাকা নিয়ে আসতে হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেয় জলদস্যুরা।

তিন জনকে অপহরণ করে নিয়ে গেলেও ছেড়ে দেওয়া বাকিদের। তিনটি ট্রলারে ২৫ জন ফিরে আসেন বৃহস্পতিবার।

শুক্রবার মৌখালিতে গিয়ে দেখা মিলল সামাদ এবং মুছার পরিবারের সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের স্ত্রীরা বললেন, ‘‘এত টাকা কোথা থেকে আসবে? কিন্তু টাকাটা জোগাড় করতে না পারলে তো ওঁদের প্রাণেও বাঁচাতে পারব না। সংসারটা ভেসে যাবে।’’ সামাদের ছেলে খালেকও বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। তাঁরই মাথা ফেটেছে দুষ্কৃতীদের মারে। বছর আঠারোর যুবক বললেন, ‘‘চোখের সামনে দিয়ে বাবাকে মারতে মারতে নিয়ে গেল। কিচ্ছু করতে পারলাম না। এখন ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরলে হয়।’’

এ দিন তৃণমূল নেতা সওকত মোল্লা গিয়েছিলেন মৌখালিতে। অপহৃত দুই মৎস্যজীবীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। জলদস্যুদের মোবাইল নম্বরেও কথা বলেন। মা মনসার মালিক হায়দার আলি মোল্লাও কথা বলেছেন ওই ফোন নম্বরে। সওকত বলেন, ‘‘জলদস্যুরা খুবই ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। কোনও কথাই শুনতে চাইছে না। ২ জনের মাথার দাম ২ লক্ষ টাকার বদলে অনেক দরাদরি করে দেড় লক্ষে নামিয়েছি। কী ভাবে ওঁদের উদ্ধার করা যায়, তা দেখছি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement