বাহিনীতে ভরসা খুঁজছে বিরোধীরা

কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ আগেও অন্যান্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। এ বার তা নিয়ে দ্রুত নড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৬ ০২:৩৯
Share:

কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ আগেও অন্যান্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। এ বার তা নিয়ে দ্রুত নড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন। প্রত্যন্ত গ্রামের ভিতরেও টহল দিয়ে ভোটারদের মনোবল বাড়ানোর নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার নসিম জাইদি।

Advertisement

তার আগে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অভিযোগের গতিপ্রকৃতি।

বনগাঁ মহকুমায় দু’দফায় চলে এসেছে দুই কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। রুটমার্চও চলছে। তবু বিরোধী দলগুলি অভিযোগ তুলছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সঠিক ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না।

Advertisement

কংগ্রেস নেতা কৃষ্ণপদ চন্দ্র বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পরিচালনা করছে স্থানীয় প্রশাসন। তাদের সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমরা চাই মহকুমার অতি উত্তেজনাপ্রবণ বুথ এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে আরও বেশি করে রুটমার্চ করানো হোক।’’ বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পঙ্কজ ঘোষের দাবি, ‘‘বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী রাস্তা দিয়ে টহল দিচ্ছে। গ্রামের মধ্যে ঢুকে রুটমার্চ করছে কই! প্রশাসন ওদের নিয়ন্ত্রণ করছে।’’

শাসক দলের পক্ষ থেকে অবশ্য কোনও অভিযোগ নেই। দলের বিদায়ী বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘২০১১ সালের পরে বিভিন্ন এলাকায় শান্তি ফিরেছে। আরও বেশি করে কেন্দ্রীয় বাহিনী গ্রামে টহল দিক। আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’’

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দু’ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক দিকে, গ্রামে গ্রামে রুটমার্চ করানো হচ্ছে। অন্য দিকে, প্রধান প্রধান সড়কে তাদের দিয়ে নাকা করানো হচ্ছে। বাইক বা অন্য বাহন তল্লাশি করানো হচ্ছে। এখানেও বিরোধীদের আপত্তি রয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে কেন বাইক তল্লাশি করানো হবে, তা নিয়ে।

সিপিএমের পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে স্থানীয় বালিয়াডাঙা, নতিডাঙা, শুভরত্নপুর, আলাকালীপুর, মোল্লাহাটি, আরামডাঙা, জানিপুর, সাতবেড়িয়া, সুন্দরপুর, খাবরাপোতা, পোলতা, ফলেয়া, ব্যাসপুর, চামটা, গাঁড়াপোতার মতো বহু গ্রামে পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীর রুটমার্চের দাবি করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ওই সব গ্রামে অতীতে নির্বাচনের আগে পড়ে চাপা সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। বুথ দখল, ছাপ্পা, বুথ জ্যাম, ভোটারদের রাস্তা থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া বা হুমকির মতো ঘটনা ঘটেছে। খেতের ফসল কেটে দেওয়া বা নষ্ট করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০১১ সালের আগে এলাকাগুলি ছিল সিপিএম ‘খাসতালুক।’ পরবর্তী সময়ে অবশ্য সেই জায়গা নিয়েছে তৃণমূল।

গত ৭ মার্চ থেকে শুরু করে কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা, সাগর এবং নামখানার অন্তত ৪০০টি এলাকায় টহলদারি শেষ করেছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। অতি সংবেদনশীল এলাকায় দ্বিতীয়বারের জন্যও যাচ্ছে বাহিনী। তা সত্ত্বেও উঠছে নানা অভিযোগ।

পাথরপ্রতিমা পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা তথা জোটের নির্বাচন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সত্যরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘গ্রামের একেবারে ভেতরে গিয়ে অনেক জায়গাতেই কথা বলছেন না বাহিনীর জওয়ানেরা। থানার এক অফিসারের সঙ্গে এসে এলাকা ঘুরে গিয়েছেন। কিন্তু এলাকার অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা থানায় যেতে ভয় পান। শুধু বড় রাস্তার উপর দিয়েই যদি চলে যান জওয়ানেরা, তা হলে কেউ যেচে কথা বলতে যাবে, এটাই পরিস্থিতি।’’ গোবর্ধনপুর, লক্ষ্মীজনার্দনপুর, হেরম্বগোপালপুরের মতো কিছু এলাকা থেকে এ রকমই অভিযোগ উঠে আসছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর।

কমিশনের কর্তারা জানাচ্ছেন, এমনিতেই পুলিশ এবং বাহিনী দেখলে গ্রামের মানুষ ভয় পেয়ে যান, সে সব ভয়, জড়তা কাটিয়ে তাঁদের সঙ্গে জওয়ানদের কথা বলতে বলেছে কমিশন। তারা ভোটের আগে ভয় পাচ্ছেন কিনা, এলাকায় ভোটার নন, এ রকম কোনও লোকজন এসে ভিড় বাড়াচ্ছে কিনা, অন্য কোনও রকমের আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা রয়েছে কিনা— এ সব জানার কথা অফিসারদের। পুলিশ কর্তারা অবশ্য দাবি করছেন, সে সব পুরোদস্তুর হচ্ছে। কাকদ্বীপের এসডিপিও অশেষ বিক্রম দস্তিদার দাবি করেন, ‘‘কেবল টহলদারি নয়, আমি নিজে থেকে সব এলাকায় গিয়ে কথা বলছি সাধারণ মানুষের সঙ্গে।’’

সাগর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে আরও অভিযোগ উঠছে, বাহিনীর জওয়ানদের সংবেদনশীল বা অতি সংবেদনশীল এলাকাগুলিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অনেকটা ঘুরপথে। সাগরের কংগ্রেস প্রার্থী অসীম মণ্ডল বলেন, ‘‘এটা করা হচ্ছে খুবই কায়দা করে। এখন পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে ঘুরছে বাহিনী। পরে গোলমাল বাধলে ঘুরপথে যেতে ঢের দেরি হয়ে যাবে।’’ অভিযোগ, সাগর ব্লকের ১৭১টি বুথের মধ্যে ১৫টি বুথের ক্ষেত্রে এ রকম সমস্যা সামনে এসেছে। ধসপাড়া-সুমতিনগর ১ অঞ্চলের গোবিন্দপুর, গঙ্গাসাগর অঞ্চলের চণ্ডীপুর-মহিষামারি, ধবলাট অঞ্চলের গোলকপুর, বসন্তরাজপুরে বাহিনী নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ রকম অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা।

সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক তথা যাদবপুরের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন টহলদারির খুব সুব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নিচুতলার পুলিশকর্তা এবং প্রশাসনিক অফিসারদের জন্য।’’

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চন্দ্রশেখর বর্ধন অবশ্য বলেন, ‘‘আমার এলাকায় কমিশনের নির্দেশে খুব ভাল ভাবে কাজ হচ্ছে। কথা বলা হচ্ছে এলাকায় গিয়ে। অভিযোগ একেবারেই ইচ্ছাকৃত।’’

ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকার বিভিন্ন স্পর্শকাতর, অতি স্পর্শকাতর এলাকায় এখনও পর্যন্ত সেই ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে রুটমার্চ করানো হয়নি বলেও অভিযোগ উঠছে। বিরোধীদের অভিযোগ, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ক্যানিং ২ ব্লকের ৯টি পঞ্চায়েতের বিভিন্ন বুথে বিরোধী দলগুলি প্রার্থী দিয়েও শাসক দলের চাপে বা ভয়ে প্রত্যাহার করে নেয়। ক্যানিং ২ ব্লকের প্রায় প্রতিটি বুথে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় তৃণমূল। বিরোধীদের আরও অভিযোগ, ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকা তথা ক্যানিং ২ ব্লকের কালীকাতলা, সারেঙ্গাবাদ, দেউলি ১ ও ২, মৌখালি-সহ বিভিন্ন এলাকায় শাসক দলের ভয়ে সাধারণ ভোটাররা ঠিক মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না। গত লোকসভা নির্বাচনে মৌখালির দু’টি বুথে ব্যাপক রিগিং ও ছাপ্পা ভোট হওয়ায় ফের ভোটগ্রহণ করতে হয়েছিল।

ক্যানিং পূর্বের তৃণমূলের প্রার্থী সওকত মোল্লা বলেন, ‘‘সিপিএম এই এলাকায় মানুষের জন্য কিছুই করেনি। তৃণমূল সরকারের আমলে এই ক’বছরে উন্নয়নের কাজ হয়েছে। তা দেখে মানুষ সিপিএমকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ওরা দিশা হারিয়ে ভুলভাল বলছে। কমিশনে মিথ্যা অভিযোগ করছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সামনে রেখে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে। আমরা বাহিনী-সহ সকলকেই এখানে স্বাগত জানাচ্ছি।’’

জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘ক্যানিং ২ ব্লক এলাকায় দু’দিন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে রুটমার্চ করানো হয়েছিল। আরও দু’দিন বাহিনী পাঠানো হলেও মাঝপথ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ক্যানিং ও বাসন্তীতে ঝামেলার জন্য।’’

সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তুষার ঘোষ বলেন, ‘‘ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকায় এমনিতেই আইনের শাসন নেই। তার উপরে, রুটমার্চ ঠিক মতো হচ্ছে না। এ নিয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছি।’’

কাকদ্বীপের তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী মন্ত্রী ম্টুরাম পাখিরা বলেন, ‘‘বাহিনীর টহল নিয়ে আমরা খুশি। সন্ত্রাস কবলিত এলাকা এখানে নেই। বিরোধীদের অভিযোগ তোলার কথা, ওরা তা তুলবেই।’’

ভোটারদের ভরসা জোগাতে কেমন পদক্ষেপ করছে বাহিনী, পরিস্থিতি গড়াচ্ছে কোন দিকে, তা বোঝা যাবে ভোটের দিন যত সামনে আসবে।

তথ্য সহায়তা: সীমান্ত মৈত্র, সামসুল হুদা ও শান্তশ্রী মজুমদার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement