নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে রাস্তায় বনগাঁর রাজবংশী সমাজের মানুষেরা। ফাইল চিত্র।
স্বামীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় স্ত্রীর হাত ছিল, এই অভিযোগ তুলে গ্রামের লোকজন মহিলাকে ধরে মারধর করে। চুল কেটে নেয়। দিন কয়েক আগে হাবড়ার ঘটনা।
কয়েক মাস আগে বনগাঁর মেদিয়াপাড়া এলাকায় যশোর রোডের পাশে একটি হোটেলের রান্নাঘর থেকে এক মহিলার নগ্ন দেহ উদ্ধার হয়। অভিযোগ ওঠে, মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ভবঘুরে মহিলাকে শারীরিক নির্যাতন করে খুন করা হয়েছে।
হাবড়ার ঘটনায় পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করে। বনগাঁর ঘটনার কোনও কিনারা আজও পুলিশ করতে পারেনি।
সন্দেশখালিতে কয়েক মাস আগে এক বয়স্ক মহিলার উপরে নির্যাতন চালিয়ে বাড়ির পাশের ঝোপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান তিনি। মূল অভিযুক্ত জেলে। বিচারপ্রক্রিয়া চলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বধূ নির্যাতন, পণের দাবিতে মৃত্যু, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ-সহ মহিলাদের উপরে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নানা প্রান্তে। থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ কর্মীদের একাংশ মহিলাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে নানা সময়ে অভিযোগ ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে এফআইআর করতে চাইলে জেনারেল ডায়েরি (জিডি) করে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ।
গ্রামের মহিলারা অনেকেই এফআইআর এবং জিডির পার্থক্য বোঝেন না। ফলে তদন্তেও ঢিলেমি থাকে বলে অভিযোগ ওঠে। দোষীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায় না বলে অভিযোগ। এ-ও শোনা যায়, অপরাধীর সন্ধান দিতে বলা হয় অভিযোগকারিণীকেই!
বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং এডিজিকে (আইনশৃঙ্খলা) বুঝিয়ে দিয়েছেন, মহিলাদের উপরে কোনও ধরনের নিগ্রহ-নির্যাতন তিনি মোটেই বরদাস্ত করবেন না। এই প্রেক্ষিতে রাজ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার বিষয়টি আবারও সামনে এসে পড়েছে।
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য স্বপ্না ঘোষ বলেন, ‘‘অতিমারি পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক সময়ে মহিলাদের উপরে গার্হস্থ্য হিংসা এবং নির্যাতন বেড়েছে। এ সব ঘটনায় জেলার শহর অঞ্চলে পুলিশ-প্রশাসন সদর্থক ভূমিকা নিচ্ছে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়।’’ সমিতি সূত্রে জানানো হয়েছে, লকডাউন পরিস্থিতিতে বাড়ির পুরুষদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকের রুজি-রোজগার কমে গিয়েছে। সেই হতাশা, বিরক্তি সব বাড়ির মহিলাদের সহ্য করতে হচ্ছে। ঢালাও মদের কারবার চলছে। পুরুষেরা নেশা করে মহিলাদের উপরে নির্যাতন করছে।
বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার মহিলা মোর্চার সভানেত্রী ভাস্বতী সোম বলেন, ‘‘বিধানসভা ভোটের পর উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় বিজেপি করার জন্য মহিলাদের উপরে নির্যাতন করা হয়েছে। আট বছরের মেয়েকেও বাদ দেওয়া হয়নি। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ নেয়নি। অনেকে আবার ভয়ে অভিযোগ করতে যেতে সাহস পাননি।’’
আইনজীবীদের একাংশ আবার মনে করেন, পুলিশ যদি বা অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে, কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য অপরাধীর সাজা হতে হতে বহু বছর গড়িয়ে যায়। অনেক সময়ে দীর্ঘ দিন জামিনে ছাড়া থাকা অবস্থায় অপরাধীরা অভিযোগকারিণীর উপরে চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভয়ে মামলা প্রত্যাহারও করে নেন কেউ কেউ। আদালতের বাইরে টাকা-পয়সা দিয়ে ‘মিটমাট’ হয়ে যায় বলেও জানালেন আইনজীবীরা।
বনগাঁ মহকুমা আদালতের মুখ্য ভারপ্রাপ্ত সরকারি আইনজীবী সমীর দাস বলেন, ‘‘বনগাঁ আদালতে সব মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার বধূ নির্যাতনের মামলা ঝুলে আছে। কোনও কোনও মামলা ১২-১৪ বছর ধরেও চলছে।’’
কেন এত দেরি?
সমীরবাবু জানান, বনগাঁ আদালতে কেবল জেএম এবং এসিজেএম কোর্টে বধূ নির্যাতনের মামলাগুলির বিচার হয়। কোর্টের সংখ্যা না বাড়লে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে না। বিষয়টি হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার এবং প্রধান বিচারপতিকেও জানানো হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সাক্ষ্যগ্রহণে দেরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ চার্জশিট দেরি করে দেয় বলেও জানালেন সমীর। তাঁর মতে, এমনও দেখা গিয়েছে ২-৩ বছর পরেও চার্জশিট জমা পড়েছে।
বনগাঁ আদালতের আইনজীবী দীপাঞ্জয় দত্ত বলেন, ‘‘করোনা পরিস্থিতিতে মহিলাদের উপরে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা বেড়েছে। আমার কাছেই ১০টি মামলা আছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কিছু মহিলা ভুয়ো মামলাও করছেন।’’
নারী নির্যাতনের সংখ্যা যে বাড়ছে, তা পরিসংখ্যান থেকেও স্পষ্ট। হাবড়া থানা এলাকায় গত দেড় মাসে ৩০টির বেশি নারীদের উপরে অপরাধের মামলা হয়েছে। বেশিরভাগ অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়েছে। নাবালিকা নির্যাতনের ঘটনায় ১৫ দিনেও একটি চার্জশিট সম্প্রতি দিয়েছে হাবড়া থানা।
পুলিশ জানিয়েছে, বধূ নির্যাতনের মামলায় অভিযুক্তকে অনেক ক্ষেত্রে এখন অভিযোগ পাওয়ামাত্র গ্রেফতার করা হয় না। সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে, অভিযুক্তদের প্রথমে নোটিস করে ডাকা হয়। বারাসত জেলা পুলিশ সুপার রাজনারায়ণ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নারীদের উপরে অপরাধের অভিযোগগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।
প্রতিটি থানায় আলাদা করে মহিলাদের জন্য ‘হেল্প ডেস্ক’ আছে। সেখানে মহিলা পুলিশ অফিসার থাকেন।’’ বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদার বলেন, ‘‘মহিলাদের উপরে হওয়া অপরাধের ঘটনাগুলি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।’’
গার্হস্থ্য হিংসা বিষয়ে জেলাস্তরে একজন ‘প্রোকেটশন অফিসার’ আছেন। তিনি স্বামী-স্ত্রী বা পরিবারের লোকজনের কাউন্সেলিং করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অ্যান্টি হিউম্যান ট্র্যাফিকিং ইউনিট আছে। সেখানে একজন মহিলা ওসি থাকেন। তিনি জেলার থানাগুলিতে হওয়া মহিলাদের অপরাধের মামলাগুলি তদারক করেন। বনগাঁয় মহিলা থানা হয়েছে।
তবে এর ফলে মহিলারা আলাদা বিশেষ কোনও সুবিধা পাচ্ছেন কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মহিলাদের খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনায় মহিলা থানার কার্যকারিতা তেমন চোখে পড়ে না বলে অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রে মহিলা থানার সেই লোকবল নেই বলে মানছেন পুলিশ কর্তাদের একাংশ। সে ক্ষেত্রে সাধারণ থানা এ বিষয়ে ভূমিকা পালন করে। বারাসত ও বনগাঁ পুলিশ জেলায় একটি করে মহিলা থানা আছে। বসিরহাট পুলিশ জেলায় কোনও মহিলা থানাই নেই।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি, বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘জেলায় আমাদের নেতা-কর্মীদের স্পষ্ট করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, মহিলাদের সঙ্গে অশালীন-অভব্য আচরণ করা যাবে না। কুকথা বলা যাবে না। এ সব করলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিরুদ্ধে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ করছে। দলের কেউ যুক্ত থাকলেও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’’