ঠাঁই: উপেন আড়ির মাটির ঘর। নিজস্ব চিত্র
ডাঁসা নদীর পাশে একটি জলাশয়ে বিকেলে চোখে মুখে জল দিয়ে উঠে তরণী সর্দার বলেন, “এই জলাশয়ের জায়গাতেই আমপানের আগে আমাদের মাটির বাড়ি ছিল। আমপানের পরে বাঁধ ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বাড়ি। এই জায়গা থেকে মাটি কেটে বাঁধ তৈরি হয়েছে। তাই জলাশয় তৈরি হয়েছে।”
হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের রূপমারি পঞ্চায়েতের বাইনাড়া কাছারিপাড়ায় দরিদ্র আদিবাসী পরিবারের বাস। আমপানের সময়ে এই অংশে ডাঁসা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ভেঙে যাওয়া বাঁধের পাশে যে কয়েকটি মাটির বাড়ি ছিল, সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সরকারি সাহায্যে তৈরি হওয়া যে কয়েকটি পাকা বাড়ি ছিল, সেগুলি দীর্ঘ দিন ধরে নদীর জলে ডুবেছিল। দরিদ্র পরিবারগুলি এক বছরের বেশি সময় বাড়ি ছাড়া ছিলেন। তাঁবুতে, বাঁধের উপরে দিন কেটেছে। কয়েক মাস হল বাড়ি ফিরেছেন তরণীরা।
তরণীর অন্যত্র জমি-জায়গা নেই। দুই মেয়ে, অসুস্থ স্ত্রী ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আগে যেখানে মাটির বাড়ি ছিল, তার পাশে প্রতিবেশীর জায়গায় ত্রিপলের ঝুপড়ি করে আছেন। ঝুপড়িতে হাঁস-মুরগিও থাকে। তরণী জানান, গ্রামে কাজ নেই। সকলকে ছেড়ে ভিন্ রাজ্যে কাজেও যেতে পারছেন না। যা হোক করে খাওয়া জুটছে। মাটির ঘর করার ক্ষমতাও নেই। আগে যে ৫ কাঠা জায়গায় বসবাস করতেন, সেখানে এখন জলাশয়। সেখানে মাটি ফেলে উঁচু করে মাটির ঘর করার আর্থিক সামর্থ্য নেই বলে জানালেন তরণী।
এ দিকে, যাঁর জায়গায় বাস করছেন, তিনিও সরে যেতে বলছেন। তরণীর বড় মেয়ে মন্দিরা নবম শ্রেণিতে পড়ে। মন্দিরা জানায়, বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ নেই। প্রতিবেশীদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। ত্রিপলের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে ভয় পান বাবা। সন্ধে নামলে বাড়িতে পড়তে পারে না মন্দিরা। প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে অল্প সময়ে পড়ে বলে জানাল। ফোন বা টর্চ অন্যের বাড়িতে চার্জ দিতে হয়।
তার বোন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তারও খুব সমস্যা হয় পড়াশোনা করতে। মন্দিরার কথায়, ‘‘আগে যখন মাটির বাড়ি ছিল, তখন একটা ভাঙাচোরা শৌচাগার ছিল। এখন তা-ও নেই। প্রতিবেশীদের কারও বাড়িতেই পাকা শৌচাগার নেই। তাই খুব সমস্যা হয়। পাখা নেই। গরমে কষ্ট হয় ঝুপড়ির ভিতরে থাকতে।’’
এই পাড়ায় মাটির ঘর ছিল প্রায় ন’জনের। আমপানের সময়ে বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে সে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে পাড়া ছেড়ে কিছুটা দূরে চাষের জমিতে ঘর করে আছেন অঞ্জলি বৈদ্য, কৃষ্ণ বৈদ্য, নিরঞ্জন বৈদ্য, মনো বৈদ্যরা। যাঁদের অন্যত্র যাওয়ার জায়গা নেই, তাঁরা আবার মাটির ঘর তৈরি করেছেন। যেমন তুফান সর্দার, উপেন আড়ি।
তুফান দুই বাচ্চাকে বাবা-মায়ের কাছে রেখে স্বামী-স্ত্রী ভিন্ রাজ্যে কাজে চলে গিয়েছেন। উপেনের ছেলেও ভিন্ রাজ্যে কাজে গিয়েছেন। বাড়িতে বৃদ্ধ উপেন ও স্ত্রী থাকেন। বৃদ্ধ বলেন, "মাটির ঘর ভেঙে যেতে আবার মাটি দিয়ে একটু উঁচু করে ছোট্ট কুঁড়ে ঘর করেছি বহু কষ্টে। এ ছাড়া আমাদের সামর্থ্য নেই। গ্রামে কাজ নেই। ছেলেকে ভিন্ রাজ্যে কাজে যেতে হয়েছে।’’
ভোট নিয়ে কী ভাবছেন?
এ কথা শুনে সকলে এর ওর মুখের দিকে তাকান। উপেন বলেন, ‘‘ভোট তো দিতেই হবে। তখন ছেলেও বাড়ি ফিরবে। কিন্তু একটা পাকা শৌচাগার পেলাম না। পাকা ঘরও হল না। বহু বছর ধরে মাটির বাড়িতে থাকি। এই সব সমস্যার সমাধান করবেন নেতারা, এমন আশা তো করি। হয় আর কত টুকু!”
স্থানীয় বাসিন্দা পার্বতী সর্দার বলেন, “সরকারের দেওয়া পাকা ঘরে থাকলেও দেওয়ালে প্লাস্টার নেই। নোনা জলে দীর্ঘ দিন ডুবে থেকে গোটা বাড়ি নোনা লেগে গিয়েছে। বাড়ির ভিতরে ফাটল ধরেছে। চালের ক্ষতিও হয়েছে।” স্থানীয় বাসিন্দা সীতা সর্দার বলেন, “আমপানের আগে গ্রামে দু’টো টিউবওয়েল ছিল। সেগুলো আমপানের পর থেকে অকেজো। পানীয় জলের খুব সমস্যা। ভোট তো দিতে হবে, কিন্তু প্রচারে এলে এই সমস্যার কথা নেতাদের ফের বলব। জানি না, কতটা কী কাজ হবে!”
রূপমারি পঞ্চায়েতের প্রধান সনাতন সর্দার বলেন, “শৌচাগারের বিষয়টি দেখা হচ্ছে। কিছু শৌচাগারের কাজ দ্রুত শুরু হবে। পানীয় জল বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজও চলছে। যাঁদের মাটির বাড়ি আছে, তাঁরা যাতে পাকা বাড়ি পান, তা দেখা হবে।”