ধৃত: আদালতের পথে। নিজস্ব চিত্র।
একদল লোক একটি বাড়ির তিনটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছিল কয়েক মাস ধরে। সবাই দেখে, তারা আসে-যায়। কিন্তু তারা কী কাজ করে, কোথায় যায়, তা জানা ছিল না পাড়ার কারও। নৈহাটি পুরসভার এক কর্মী প্রায়ই সেই বাড়িতে আসত।
রবিবার রাতে নৈহাটির মিত্রপাড়ার সেই বাড়িতে পুলিশ আসার আগে পর্যন্ত ভাড়াটেদের পরিচয় জানা যায়নি। সাত ভাড়াটেকে গ্রেফতার করে পুলিশ জানায়, ধৃতেরা কিডনি পাচার-চক্রের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার করা হয়েছে বাড়ির মালিক বিশ্বজিৎ পালকেও।
সোমবার ভোরে পুলিশ নৈহাটি পুরসভার কর্মী সরফরাজ আহমেদকে গ্রেফতার করে। পুলিশ জানিয়েছে, সে এই চক্রের ‘লিঙ্কম্যান’। ভাড়াটেদের অধিকাংশই ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দা। তাদের কিডনি দিয়েই চলছিল ব্যবসা। সরফরাজ এবং বিশ্বজিৎ সেই চক্রের সদস্য। চক্রের চাঁইয়েরও খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। সে কলকাতার বাসিন্দা। কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে কিডনি বিক্রি করত ওই চক্র। এমন ঘটনায় তাজ্জব পুলিশও। তাদের এলাকায় এমন কারবার চলছিল জেনে বিস্মিত পাড়ার বাসিন্দারাও।
পুলিশ জানিয়েছে ধৃতদের নাম উদয়চন্দ্র দাস, আনসারুল হক, ভারতী ছেত্রি, ইকবাল আহমেদ আনসারি, সুরেশচন্দ্র চৌধুরী, রাজেন্দ্র শর্মা এবং স়ঞ্জয় শর্মা। উদয়চন্দ্র এবং আনসারুল মালদহের চাঁচলের বাসিন্দা। ভারতীর বাড়ি অসমে। বিহারের বাসিন্দা ইকবাল। সুরেশচন্দ্র উত্তরাখণ্ড এবং রাজেন্দ্র ও সঞ্জয় রাজস্থানের বাসিন্দা। সম্প্রতি ইএম বাইপাস লাগোয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে কিডনি নেওয়া হয়েছে উদয়চন্দ্রের।
নৈহাটির পুরপ্রধান অশোক চট্টোপাধ্যায় মিত্রপাড়ারই কাউন্সিলর। বিতর্কিত বাড়ির মালিক বিশ্বজিৎও তাঁর পরিচিত। তিনি বলেন, ‘‘কখনও ওই বাড়িতে ভাল কিছু হতে দেখিনি। কখনও চিটফান্ড, কখনও চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রতারকদের ভাড়া দেওয়া হত।’’ ফলে ওই বাড়িতে কারা আসছে, কারা থাকছে, তা নিয়ে পাড়ার বাসিন্দাদের কারও বিশেষ আগ্রহ ছিল না। সরফরাজ নৈহাটি পুরসভার পাম্প অপারেটর। পুলিশ জানিয়েছে, সে-ই চক্রের লিঙ্কম্যান। কারবারের চাঁইয়ের শাগরেদ হিসেবে কাজ করত সরফরাজ। তার দায়িত্ব ছিল ভিন্ রাজ্য বা বাইরের জেলা থেকে আসা কিডনি বিক্রেতাদের থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য ব্যবস্থা করে দেওয়া। তাকে সাসপেন্ড করা হবে বলে জানিয়েছে নৈহাটি পুরসভা।
সরফরাজের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ উঠেছে। পুর চেয়ারম্যান অশোকবাবু জানান, ২০১৪ সালে পুরসভায় স্থায়ী কর্মী হিসেবে চাকরি পায় সে। বছরখানেক আগে হায়দরাবাদ থেকে জনা তিনেক লোক পুরসভায় সরফরাজের খোঁজে আসেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন, সরফরাজের সঙ্গে তাঁদের লেনদেন নিয়ে সমস্যা হয়েছে। সেই সময়ে অশোকবাবু সরফরাজকে ডেকে পাঠান। সে দাবি করেছিল, তার সঙ্গে কারও কোনও সমস্যা হয়নি। তা ছাড়া, হায়দরাবাদের বাসিন্দারা কোনও লিখিত অভিযোগ না করায় সরফরাজের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
কী ভাবে কাজ চালাত এই চক্র?
ব্যারাকপুর কমিশনারেটের ডিসি (জোন ১) কে কান্নন জানান, চক্রটি কলকাতা থেকে চালানো হলেও ভিন্ রাজ্য এবং জেলাতেও তাদের আড়কাঠি রয়েছে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে কিডনি বিক্রেতাদের জোগাড় করে কলকাতায় পাঠাত।
কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে কিডনি পাচার হলেও বিক্রেতাদের রাখা হত নৈহাটিতে। খদ্দের মিললে তাদের পাঠানো হত কলকাতার হাসপাতালে। পুলিশ জানিয়েছে, কিডনি বিক্রির সময়ে বিক্রেতার আসল পরিচয় গোপন রাখা হত। সেই জন্য তাদের জাল পরিচয়পত্রও ব্যবহার করা হত। তেমনই কয়েকটি জাল পরিচয়পত্র মিত্রপাড়ার ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধৃতদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে আরও তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।