কাশীপুর থানা এলাকায় পুলিশের রুটমার্চ। নিজস্ব চিত্র
গোটা রাজ্যে বিধানসভা ভোটে একটি মাত্র আসনে জয়ী হয়েছিলেন আইএসএফ প্রার্থী। তবু সেই আসন, ভাঙড়ই ‘গলার কাঁটা’ হয়ে উঠেছে শাসক দল তৃণমূলের।
গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে নানা ভাবে এলাকায় রাজনৈতিক আধিপত্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে তৃণমূল। কিন্তু ‘বহুধা-বিভক্ত’ শাসক শিবির ‘এককাট্টা’ আইএসএফের সঙ্গে এখনও পুরোদস্তুর যুঝে উঠতে পারছে না বলে মত স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের। বরং যত দিন যাচ্ছে, ততই ভাঙড়ে শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে আইএসএফের। শুধুমাত্র ভাঙড়ে জনসমর্থনকে সম্বল করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী। সম্প্রতি একটি মাদ্রাসার ভোটেও ভাল ফল করেছে তারা। আর এ সবের ফলে তৃণমূলের সঙ্গে গোলমাল লেগেই আছে আইএসএফের। শনিবার কলকাতার রাজপথেও আইএসএফ কর্মী-সমর্থকদের রণংদেহি মূর্তি দেখেছেন রাজ্যবাসী। পুলিশকে পরিস্থিতি সামাল দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে নওশাদ-সহ অনেককে।
কী কারণে এত অল্প সময়ের মধ্যে একটি আসন পাওয়া বিরোধী দল এত শক্তি সংগ্রহ করল?
তৃণমূলের একটি সূত্রের মতে, কারণ লুকিয়ে আছে তাদের নিজেদের দলের কর্মকাণ্ডের মধ্যেই। দুর্নীতি, সিন্ডিকেট রাজ এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ বিস্তর। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ভাঙড় এবং আশপাশের এলাকায় ক্রমশ প্রভাব বাড়ছে আইএসএফের, এমনটাই মত তৃণমূলের ওই অংশের। একই দাবি করছেন আইএসএফ নেতারাও।
ভাঙড় ২ ব্লকের হাতিশালা এলাকায় ১০০-১৫০ মিটারের মধ্যে তৃণমূলের চারটি দলীয় কার্যালয় চোখে পড়বে। দলের একটি সূত্রে জানা গেল, নিউটাউন-লাগোয়া ভাঙড়ের হাতিশালায় শাসকদলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতাদের আলাদা আলাদা দলীয় কার্যালয় আছে। হাতিশালার সিক্স লেনের মুখে আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা তথা রেজাউল করিম ঘনিষ্ঠ আইএনটিটিইউসি ব্লক সভাপতি জুলফিকার মোল্লার দলীয় কার্যালয়। সেখান থেকে সামান্য দূরে আরাবুল ঘনিষ্ঠ শ্রমিক নেতা শামিমউদ্দিনের কার্যালয়। তার কিছুটা দূরে যুবনেতা রশিদ মোল্লার কার্যালয়। আর একটু এগোলে আরাবুল ঘনিষ্ঠ সাবির মোল্লার কার্যালয়।
ভাঙড়ে এমনিতেই আরাবুল ইসলাম, আব্দুর রহিম মোল্লা, জুলফিকার মোল্লা, কাইজার আহমেদ, বাহারুল ইসলামেরা আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে পরিচিত। অভিযোগ, বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর ওই সব নেতাদের দলীয় কার্যালয় থেকে চালানো হয় ‘সিন্ডিকেট রাজ।’ এলাকায় জলাজমি দখল থেকে শুরু করে, জলাভূমি ভরাট, বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পে ইট, বালি, পাথর, সিমেন্ট, রড সরবরাহের জন্য সিন্ডিকেট চালানো হচ্ছে। দলের একটি সূত্রের মতে, এ সব নিয়েই ভাঙড়ে শাসকদলের মধ্যে যত গন্ডগোল। প্রায়ই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে গন্ডগোল বাধে। নিচুতলার কর্মীরা দ্বিধাগ্রস্ত। তা ছাড়া, শাসকদলের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। মানুষ অতিষ্ঠ। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে কাটমানি দিতে হয় বলে অভিযোগ। কেউ জমি কিনে ঘর-বাড়ি, দোকান করতে গেলে নেতাদের মোটা অঙ্কের নজরানা গুনতে হয় বলে অভিযোগ।
দীর্ঘ দিন ধরে ভাঙড় ১ ও ২ ব্লকে তৃণমূলের কোনও ব্লক সভাপতি, যুব সভাপতি নেই। ফলে ভাঙড়ে কে নেতা, তা বুঝতে পারছেন না দলের কর্মীরাই— মত নেতৃত্বের একাংশের।
স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের মতে, এ সবেরই সুযোগ নিচ্ছে আইএসএফ। সাধারণ মানুষের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। নানা দুর্নীতির অভিযোগে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায় দলের নেতাদের। বিধায়ক নওশাদও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
আইএসএফকে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না তৃণমূলের কোনও গোষ্ঠীর নেতাই। আরাবুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আছে। কিন্তু দলের বিষয়ে ভাঙড়ে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ। দলের স্বার্থে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করি।’’ কাইজার আহমেদের কথায়, ‘‘ওই এলাকায় আমাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের দলীয় কার্যালয় রয়েছে। তবে দলের স্বার্থে আমরা সকলে এক। কিছু ক্ষেত্রে কয়েক জন নেতা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিভেদ তৈরি করেন। আমরা দলগত ভাবে চেষ্টা করছি সকলকে এক সঙ্গে, এক ছাতার নীচে আনার।’’
অন্য দিকে, আইএসএফের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি আব্দুল মালেক মোল্লা বলেন, ‘‘আমরা গরিব, মেহনতি মানুষের পাশে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। সে কারণেই মানুষ আস্থা রাখছেন। তৃণমূলের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়েও আমাদের সঙ্গে আসছেন।’’