কচুরিপানা তোলার পর ইছামতী। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
স্রোতস্বিনী ইছামতী নদী নাব্যতা হারিয়ে অনেক দিন ধরেই মৃতপ্রায়। পলি জমে নদী গতিপথ হারিয়েছে। নদীতে এখন আর জোয়ার-ভাটা খেলে না।
নদীর এই করুণ পরিণতির ফলে ফি বছর বর্ষায় বনগাঁ শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষকে জলবন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শহরের নিকাশি ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ইছামতী নদী। অতীতে বৃষ্টির জমা জল ইছামতী হয়েই বেরিয়ে যেত। এখন নদীর জলধারণ ক্ষমতা নেই। ফলে জমা জল তো বের হয়ই না, উল্টে নদীর জল লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। নদীপাড়ের বাসিন্দারা দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন।
কয়েক দিন পর বনগাঁ শহরের মানুষ পুরভোটের লাইনে দাঁড়াবেন। যে কোনও ভোটের আগে শহরের সচেতন মানুষের আলোচনায় উঠে আসে ইছামতী নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের কথা। এ বারও বাসিন্দারা চাইছেন, যে দলই ভোটে জিতে বোর্ড গড়ুক, তারা যেন ইছামতী নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের বিষয়ে পদক্ষেপ করে।
বনগাঁ শহরের বাসিন্দা কবি স্বপন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে ইছামতী সংস্কারের কথা শুনে আসছি। বাস্তবে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। নদী থেকে পলি, কচুরিপানা তোলা হচ্ছে। সেই পলি পরবর্তী সময়ে নদীর জলেই মিশে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও নদী ঘিরে ফেলা হয়েছে। নদীতে আবর্জনা ফেলা হয়। প্রশাসন নদী সংস্কারে পদক্ষেপ না করলে নদীর মৃত্যু হয়ে যাবে। বনগাঁরও সমূহ ক্ষতি হবে।’’
খাতায়-কলমে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের পাবাখালি এলাকায় চূর্ণি ও মাথাভাঙা নদীর সংযোগস্থলে মাথাভাঙা নদী থেকে ইছামতীর সৃষ্টি। যদিও এখন কার্যত কোনও উৎস মুখ নেই আন্তর্জাতিক ওই নদীটির। ২০০৫ সাল থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যের পক্ষ থেকে কয়েক বার পলি তুলে নদী সংস্কারের কাজ হলেও ইছামতীর হাল ফেরেনি। বনগাঁ শহরে নদী ড্রেজ়িং করে কখনও পলি তোলা হয়নি। নদী বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, পাবাখালিতে ইছামতীর উৎসমুখ সংস্কার জরুরি।
পুরভোটে বিরোধী দলগুলি বনগাঁ শহরের বেহাল নিকাশি এবং ইছামতী সংস্কার না হওয়ার বিষয় নিয়ে সরব হয়েছে। বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য তথা ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী মধুসূদন মণ্ডল বলেন, ‘‘শহরে কিছু নিকাশি নালা তৈরি করা হয়েছে এটা ঠিক। তবে তা দিয়ে জল বের হওয়ার কোনও আউটলেট নেই। অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু হয়নি। ইছামতী নদীর সংস্কার হয়নি। উল্টে তৃণমূলের সময়ে নদী বেচে দেওয়া হয়েছে।’’
বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘‘বনগাঁর সব থেকে বড় সমস্যা বেহাল নিকাশি। ইছামতী নদীর সংস্কার হয়নি। পাশাপাশি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল-বিল-বাঁওড় সংস্কার হয়নি। শহরে অপরিকল্পিত ভাবে বাড়ি-ঘর তৈরি হয়েছে। জমা জল বের হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করা না গেলে আগামী দিনে বনগাঁ শহর জলের তলায় চলে যেতে পারে।’’
গত বছরও কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পুরসভার কয়েকটি এলাকায় জল জমে গিয়েছিল। শহরবাসীর অভিযোগ, নিকাশি নালা দিয়ে জল বের হয় না। হাইড্রেনগুলিতে আবর্জনা জমে থাকে। গভীর ওই নালায় নেমে আবর্জনা সাফ করা পুরসভার কর্মীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। পুরসভা সূত্রে জানানো হয়েছে, ওই সমস্যা সমাধান করতে আধুনিক যন্ত্র কেনা হয়েছে।
বিদায়ী পুরপ্রশাসক গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘১১ লক্ষ টাকা দিয়ে মেশিনটি কেনা হয়েছে। এই মেশিন দিয়ে ৬০ মিটার নীচে থাকা জল, আবর্জনা তুলে আনা যাবে। শহরের হাইড্রেনগুলিতে জমে থাকা আবর্জনা ইতিমধ্যেই ওই মেশিন দিয়ে পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়েছে। এর ফলে শহরের জমা জল দ্রুত সরানো সম্ভব হচ্ছে।’’ তাঁর দাবি, কোথাও জল জমে থাকলে তা-ও মেশিন দিয়ে দ্রুত সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে গত বছর মানুষের দুর্ভোগ কমানো গিয়েছে।
পুরসভা সূত্রে জানানো হয়েছে, শহর এলাকায় নদী থেকে কচুরিপানা তোলা হয়েছে। নদী এখন কচুরিপানা মুক্ত। শহরের একটা বড় অংশের জমা জল যশোর রোডের পাশে থাকা নয়ানজুলি দিয়ে বেরিয়ে খাল-বিল হয়ে ইছামতীতে পড়ত। অভিযোগ, যশোর রোডের নয়ানজুলিগুলি জবরদখল হয়ে গিয়েছে। কিছুটা ভরাট হয়ে গিয়েছে। নির্মাণ কাজ হয়েছে। নয়ানজুলিতে বৃষ্টির জমা জমে ডোবার আকার নেয়। তার মধ্যে প্লাস্টিক, আবর্জনার স্তূপ পড়ে থাকে। মশার উপদ্রব হয়। পুরসভার পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই নয়ানজুলি সাফ করা হয়েছে। নয়ানজুলিগুলি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে। খাল-বিল সংস্কারে পরিকল্পনা করা হয়েছে।
গোপাল বলেন, ‘‘ইছামতী থেকে ড্রেজিং করে পলি তোলা এবং নদীতে গতিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করা হবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা কচুরিপানা দিয়ে হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরি করছেন। এর ফলে ৪ হাজার মহিলা স্বনির্ভর হবেন। নদীতে কচুরিপানার সমস্যাও থাকবে না।’’