সরকারি নজরদারি আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বার বার অভিযোগ ওঠে সরকারি প্রকল্পে বাড়ি তৈরির গুণমান নিয়ে। উপভোক্তারা অনেকে অভিযোগ করেন, কাঁচামাল ভাল নয়। যে টাকার কাজ হওয়ার কথা, তার থেকে কম টাকাতেই কাজ করানো হচ্ছে। তা নিয়ে দলবাজির অভিযোগও কম ওঠে না। বিতর্কের নিরসনে নানা সময়ে তৈরি করতে হয় তদন্ত কমিটি। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়— এমন উদারহণও অচেনা নয়।
কিন্তু এ ধরনের বিতর্ক এড়াতে এবং সরকারি প্রকল্পে বাড়ির তৈরিতে দুর্নীতি ঠেকাতে উদ্যোগী হয়েছে তৃণমূল পরিচালিত গোবরডাঙা পুরসভা। সরকারি প্রকল্পে বাড়ি তৈরির আগে প্রাপকদের ডেকে রীতিমতো বৈঠক করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রকল্পের খুঁটিনাটি তথ্য। যাতে প্রাপকেরা নিজেরাই বাড়ি তৈরির সময় দেখেশুনে নিতে পারেন, সে প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। নিজে থেকে দাঁড়িয়ে, মালপত্রের গুণমান যাচাই করে নিতে পারবেন উপভোক্তারা।
পুরসভা সূত্রের খবর, পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘হাউস ফর অল’ প্রকল্পে এ বার পুরসভা ১১২০টি পরিবারকে বাড়ি তৈরি করে দেবে। প্রকল্পটিতে এক একটি বাড়ি তৈরি করতে ৩ লক্ষ ৬৮ হাজার টাকা খরচ পড়ছে। যার মধ্যে দেড় লক্ষ টাকা দেবে কেন্দ্র সরকার। প্রাপককে ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে। আর বাদবাকিটা দেবে রাজ্য।
কারা ওই প্রকল্পে বাড়ি পাচ্ছেন? পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, পুর এলাকার যে সব বিপিএল তালিকাভুক্ত মানুষের নিজস্ব জমিটুকু অন্তত আছে, তাঁরাই এই প্রকল্পে বাড়ি পাচ্ছেন। বাড়ি পেতে হলে ন্যূনতম ৩৪৬ স্কোয়ার ফুট জমি থাকা প্রয়োজন। প্রতি বাড়িতে থাকছে, একটি ছোট ঘর, একটি বড় বসার ঘর, বাথরুম, রান্নাঘর, ও একটি ছোট বারান্দা। বাড়ির টাকা ছাড়া পুরসভা প্রত্যেকটি বাড়ি-পিছু নিজস্ব তহবিল থেকে ১৩ হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পুরপ্রধান সুভাষ দত্ত বলেন, ‘‘সাধারণত ওই সব বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে কলম তৈরি করা হয় না। আমরা বাড়ি-পিছু ১০টি কলম তৈরি করব। বাড়িগুলি যত্ন নিয়ে তৈরি করতে চাই।’’
এই যত্নে যে কোনও খামতি থাকছে না, তা বোঝাতেও বদ্ধপরিকর পুর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে প্রাপকদের আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাড়ির মাপ কী হবে, উচ্চতা কী হবে, ঘর-বারান্দার মাপ কেমন থাকবে, ক’টা দরজা-জানালা থাকবে। এখানেই শেষ নয়, কোন সংস্থার সিমেন্ট-রড ব্যবহার করা হবে, ঢালাই করার সময়ে ক’টা সিমেন্টের ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে, তা-ও প্রাপকদের জানানো হয়েছে। মিস্ত্রিরা সঠিক ভাবে কাজ করছেন কিনা, তা নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে দেখভাল করতে পারবেন উপভোক্তারা।
পুরসভার এই উদ্যোগে খুশি তাঁরা। অনেকে বললেন, ‘‘সরকরি কাজে এমন স্বচ্ছতা আগে দেখা যায়নি। মনে হচ্ছে, আমরা যেন নিজেরাই নিজেদের বাড়ি করছি।’’ হান্নান মণ্ডল নামে এক উপভোক্তা ভ্যান চালান। জানালেন, বাড়িতে থাকার সময় কম। বাড়ি তৈরির বিষয় খুব একটা যে বোঝেন, তা-ও নয়। কিন্তু পুরসভা বৈঠক করে সবটা খোলসা করে দেওয়ায় এ বার গোটা ব্যাপারটা ধরেত পেরেছেন। সাহাপুরের বাসিন্দা ডলি রায় বলেন, ‘‘বাড়ি তৈরি হলে পুরসভা থেকে প্ল্যান অনুমোদন করতে হয়। ঠিক মতো বাড়ির নকশা করার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কিন্তু পুরসভা নিজেরাই বাড়ির প্ল্যান তৈরি করে আমাদের দিয়ে দিয়েছে। ফলে প্ল্যান তৈরির ঝামেলা নেই।’’
ঠিকাদারেরাও পুরসভার এ হেন সিদ্ধান্তে খুশি। এক ঠিকাদারের কথায়, ‘‘অনেক সময় দেখা গিয়েছে, সরকারি প্রকল্পের নিয়ম না জানায় প্রাপকদের সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য তৈরি হয়। ঝুটঝামেলা হয়। এ বার এই সমস্যা হবে না বলেই আশা করা যায়।’’
পুরসভার এমন উদ্যোগের কারণ কী? পুরপ্রধান জানালেন, সরকারি বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে অনেক সময় নিয়ম মেনে তৈরি না হওয়ার অভিযোগ ওঠে। স্বচ্ছতা বজায় রাখতে এ কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি পুরসভার পক্ষ থেকে উপভোক্তাদের জানানো হয়েছে, যদি কেউ মনে করেন, নিয়ম মেনে কাজ হচ্ছে না, তা হলে পুরসভার হেল্পলাইনে যোগাযোগ করতে পারেন। সেই নম্বরও সকলকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।