এক সময়ে তাঁরা দুজনেই সিপিএমের লোকাল কমিটি, জোনাল কমিটি সামলাতেন। আলোচনা চলত মার্কসবাদ-লেনিনবাদ নিয়ে। দু’জনের ভাব-ভালবাসাও কম ছিল না। এ বার বিধানসভা নির্বাচনে ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকায় সিপিএমের প্রার্থী হয়েছেন প্রবীণ সিপিএম নেতা তথা জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য আজিজার রহমান মোল্লা। আর তৃণমূলের প্রার্থী সিপিএম ছেড়ে আসা বর্তমানে ক্যানিং-২ ব্লক তৃণমূল সভাপতি সওকত মোল্লা।
সময়টা ২০০৮ সাল। একই বছরের মধ্যে সিপিএমের লোকাল কমিটি ও জোনাল কমিটিতে নাম তুলে ফেলেন একদা রেজ্জাক মোল্লা ঘনিষ্ঠ সওকত। ওই বছরেই পঞ্চায়েত ভোটে জিতে ক্যানিং-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হন। তারপর থেকে শুধুই উত্থানের গল্প। পিছন ফিরে আর তাকাতে হয়নি সওকতকে।
১৯৭৭ সালে আসন পুনর্বিন্যাস হওয়ার পরে সে সময়কার ভাঙড় ও ক্যানিং বিধানসভার বেশ কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র। সে সময় থেকে এখান থেকে জিতে আসছেন রেজ্জাক মোল্লা। এর আগে অবশ্য ১৯৭২ সালে রেজ্জাক ভাঙড় বিধানসভা থেকেও বিধায়ক হয়েছিলেন। রেজ্জাকের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সওকত ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকায় ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট, ২০০৯ লোকসভা ভোটে কার্যত জাঁকিয়ে বসেন। বিরোধীশূন্য হয় এলাকা। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যখন রাজ্যে পালা বদল হয়ে ক্ষমতায় এল তৃণমূল, তখনও সওকত মোল্লার হাত ধরে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার ভোটে জিতে নবম বারের জন্য বিধায়ক হন রেজ্জাক। ২০১১ বিধানসভা ভোটের আগে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনতলায় মিটিং করতে এলে রেজ্জাক-সওকত বাহিনী তাঁর কনভয়ের উপরে হামলা করে বোমা মারে বলে অভিযোগ ওঠে। রাজ্যে সরকার
কিন্তু পরিবর্তন হওয়ার পর থেকে এই এলাকায় দাপট কমতে থাকে সওকতের। সে সময়ে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি মানিক পাইক ও শাসক দলের চাপে পিছু হঠতে থাকেন তিনি। সওকত বুঝে নেন, ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে জার্সি বদল জরুরি। অবশেষে এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সওকত যোগ দেন তৃণমূলে।
২০১২ সালের ৩০ মার্চ গভীর রাতে নিজের বাড়িতেই দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন মানিক পাইক। ফের ভাগ্য খুলে যায় সওকতের। তৃণমূলের জেলা ও রাজ্য নেতৃত্ব সওকতকে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি করে দেন।
সওকতের দলে গুরুত্ব বাড়তে থাকায় স্বভাবতই তা মানতে পারেননি পুরনো তৃণমূল কর্মীরা। অভিযোগ ওঠে, দলের অন্দরে যাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ নয়, তাঁদের নানা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সওকতের দাপটে বহু পুরনো তৃণমূল কর্মী আজও এলাকা ছাড়া বলে অভিযোগ। আর এই পুরনো তৃণমূল কর্মীরাই সওকতের মাথা ব্যথার বড় কারণ।
এলাকা ছাড়া হয়ে থাকা সিপিএম-তৃণমূল কর্মীরাই সওকতকে হারাতে একজোট হয়ে ময়দানে নেমে পড়েছেন বলে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে। এলাকায় না থাকলেও বিভিন্ন ভাবে কাজ করছে তাঁদের অনুগামীরা। যা প্রচারে নেমে টের পাচ্ছেন সওকত নিজেও। যদিও তাঁর দাপটে কেউ এলাকা ছাড়া, মানতে রাজি নন সওকত।
তবে এলাকায় সে ভাবে চোখে পড়ছে না বিরোধী দলের দেওয়াল লিখন, ফ্ল্যাগ, ব্যানার, ফেস্টুন। সিপিএম প্রার্থী আজিজার রহমান মোল্লার মত, জোর করে দেওয়াল লেখা মুছে ফেললেও মানুষের মনের দেওয়াল মুছতে পারেনি তৃণমূল।
সিপিএমের আমলে এক সময়ে মাতলা নদীর চরে ভেড়ি দখলের রাজনীতি নিয়ে খুনোখুনি লেগে থাকত। সেই থেকে তৃণমূলের আমলেও অনেক ভেড়ি রাজনীতি বেড়েছে। তবে খুনোখুনি কমেছে আগের থেকে, তা স্বীকার করেন স্থানীয় মানুষ।
ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকায় এমনিতেই পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। অভিযোগ, বাম আমলে সেই ভাবে এই এলাকায় পানীয় জল, রাস্তা-ঘাট,বিদ্যুৎ,শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। যদিও স্থানীয় মানুষের মতে, পরিবর্তনের সরকারের আমলে এলাকার বেশ কিছু বাজার এলাকায় উচুঁ বাতিস্তম্ভ বসেছে, ব্লক এলাকায় বেশ কিছু জুনিয়র হাইস্কুল, জুনিয়র হাইমাদ্রাসা, এমএসকে মাদ্রাসা সরকারি অনুমোদন পেয়েছে। আগের থেকে এলাকায় বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। যদিও বাম আমলে শুরু হওয়া কুঁড়িয়াভাঙা পাম্পিং স্টেশনের কাজ আজও শেষ না হওয়ায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু ঢালাই রাস্তা তৈরি হলেও মূল রাস্তাগুলির হাল খুবই খারাপ থাকায় বিরক্তি আছে মানুষের মধ্যে। বিরোধী পক্ষ বলছে সে সব কথা।
সিপিএম প্রার্থী আজিজার রহমান মোল্লা সেই ১৯৮০ সাল থেকে সিপিএমের পার্টি সদস্য। ১৯৮৩ ও ১৯৯৩ সালে দু’বার তিনি ভাঙড়-১ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। দু’বার জেলা পরিষদের সদস্য হন। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক আজিজার সাক্ষরতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ হেন দীর্ঘদিনের নেতা আজিজার সিপিএমের দুর্দিনে দল ছেড়ে না যাওয়ায় এ বার দল ভোটের টিকিট দিয়েছে তাঁকেই।
যদিও তিনি ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকার ভোটার হলেও এই কেন্দ্রে তাঁর পরিচিতি বেশ কিছুটা কম, মনে করছে দলেরই একাংশ। তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকার মানুষের অভিযোগ, সেই ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা এই কেন্দ্র থেকে জিতে এসেছেন সিপিএমের রেজ্জাক মোল্লা। সেই রেজ্জাকও ভোটের আগে দল বদলে এখন ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী। সে সময়ে রেজ্জাক, সওকতদের আমলে এলাকার সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারত না বলে বরাবরই অভিযোগ উঠত।
এখন দেখার, দীর্ঘদিন সিপিএমের দখলে থাকা লালদুর্গে ঘাসফুল ফোটাতে পারে কিনা তৃণমূল।