রিকশাচালক প্রমোদ আচার্য। সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
রিকশার হ্যান্ডেলে লাল পতাকা। পিছনে হুডে দলের প্রতীক কাস্তে-হাতুড়ি, আর প্রার্থীর ছবি। সেই ছবি যার, তিনিই রিকশা টানছেন। হালিশহরের দেশবন্ধু কলোনির রিকশা চালক প্রমোদ আচার্য এ বার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থী।
দীর্ঘদিন দল করছেন, কিন্তু এ বারই প্রথম ভোটে দাঁড়িয়েছেন বছর তেষট্টির প্রমোদবাবু। কেন? বললেন, ‘‘এবার কেউ দাঁড়াতে চাইছিল না। তাই আমিই দাঁড়ালাম।’’ কিন্তু সঙ্গে সমর্থক কোথায়? ফ্রেক্স, ব্যানার কই? প্রমোদবাবুর উত্তর, ‘‘কেউ আমার সঙ্গে প্রচারে বেরোলে যদি ক্ষতি হয় তার পরিবারের, তাই একলাই যা করার করব।’’ বাড়ি বাড়ি প্রচার আর একা করা যায় না। তাই সওয়ারি হোক বা না হোক, সারাদিন রিকশাটা নিয়েই ঘুরে বেড়ান তিনি। তাতে যত লোকে দেখে, ততই প্রচার।
কী বলছে দল? সিপিএমের নৈহাটি-বীজপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এখন এখানে যে অবস্থা, তাতে ভোটের প্রচার খুব মুস্কিল। সব সময় শাসকদলের হুমকির মুখে থাকতে হচ্ছে। প্রমোদবাবু যে পদক্ষেপ করেছেন সেটা যথেষ্ট বলিষ্ঠ। এ রকম মানুষেরাই এখন শাসক দলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন।’’
অতএব প্রবল প্রতিপক্ষের মুখে ষাটোর্দ্ধ এক বৃদ্ধ, একেবারে একা। প্রমোদবাবুর ভোট-লড়াইতে নেতা-কর্মী-সমর্থক সবই তিনি নিজে। নিজের রিকশায় লাল পতাকা বেঁধে, লাল টুপি আর গেঞ্জি পরে হালিশহর, কাঁচরাপাড়া, নৈহাটি পর্যন্ত ঘুরছেন।
সেই ১৯৭৪ সাল থেকে সিপিএমের সমর্থক প্রমোদবাবু। পার্টির মিছিলে মিটিং-এ প্রমোদবাবু নেই, এমনটা কখনও হয়নি। তখন দিনকালও ছিল অন্যরকম। লাল পতাকার পাশে অন্য কোনও রঙের পতাকা, ফেস্টুন টাঙানোর সাহস ছিল না কারও। সিপিএমের নেতাদের কথার উপর কথা বলার বুকের পাটা ছিল না নৈহাটি, বীজপুরের বুকে। এখন রঙ বদলেছে। তেরঙা পতাকায় ঘাসফুল চিহ্নে ছেয়ে গিয়েছে গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল। বিরোধীরা সম্পূর্ণ কোণঠাসা। তাদের সমর্থকদের কী দশা, তা বোঝা যায় প্রমোদবাবুকে দিয়েই। লাল পার্টি করি বলে কোনও স্ট্যান্ডে ঠাঁই পান না এই রিকশাচালক, জানালেন নিজেই। ‘‘সবাই বলছেন, এ সবের মধ্যে কেন জড়ালেন? মানুষ কেমন সব কিছুর মধ্যে থেকেও পাশ কাটিয়ে যেতে পছন্দ করে! ’’ বললেন প্রমোদবাবু।
প্রমোদবাবুর সম্পত্তি বলতে ব্যাঙ্কে ছ’হাজার টাকা, বাড়িতে নগদ এক হাজার টাকা, টালির চালের এক কামরার বাড়ি (মূল্য সাত হাজার টাকা) আর হাজার বারো টাকার রিকশাখানা। প্রচারের জন্য দলের থেকে টাকাপয়সা কিছু মেলেনি। টাকা ঢালতে পারেননি বলে প্রচারকর্মীও মেলেনি। ‘‘এখন আমাকে একা পেয়ে যদি মেরেও ফেলে, তাহলেও অন্তত শহীদ পরিবারের তালিকায় নামটাতো উঠবে,’’ বললেন প্রমোদবাবু। ‘‘তাই তৃণমূল যখন মাইকে গান বাজায় ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে ...’ আমিও গুনগুন করে গাই।’’
এখন সকাল সকালই রিকশা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ছেন প্রমোদবাবু। হালিশহর স্টেশন থেকে বলদেঘাটা হয়ে বৈষ্ণব পাঠাগার পর্যন্ত এক চক্কর ঘুরে পুরসভার সামনে একটু জিরিয়ে নিতে বসেছিলেন। গঙ্গার ধারে হাওয়ায় কাস্তে হাতুড়ি আঁকা লাল পতাকা রিকশার হ্যান্ডেলে পতপত করে উড়ছিল। দু’একজন সওয়ারি রিকশা যাবে কি না প্রশ্নটা করতে গিয়েও থমকাচ্ছিলেন প্রমোদবাবুর পোশাক আর রিকশাটা দেখে। উদাস মনে প্রৌঢ় রিকশাচালক বলেন, ‘‘ভোটে দাঁড়িয়ে রোজগারও কমে গিয়েছে। আগে দেড়-দু’শো টাকা হত। এখন সারাদিন ঘুরেও একশো টাকা আয় হয় না। নিজে থেকে ‘কোথায় যাবেন’ প্রশ্ন করলেও চেনা যাত্রীরা এখন রিকশায় উঠতে চাইছেন না। খুব অবাক লাগে জানেন। এই বয়সেও জীবনকে নতুন করে চিনছি।’’